1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘গুলি নেই, এটাই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা'

গৌতম হোড়
১৪ জানুয়ারি ২০২২

ভারতের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলির অবস্থা ভয়াবহ৷ তবু এখানেই থাকতে চান শরণার্থীরা৷ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে৷

https://p.dw.com/p/45Wsc
TABLEAU | Weltflüchtlingstag 20.6.2021 Bildergalerie
ছবি: DANISH SIDDIQUI/REUTERS

ইয়াকুবের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল দিনদুয়েক আগে৷ সকাল ১০টার মধ্যে তাদের ক্যাম্পে পৌঁছানোর কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম৷ আচমকা বৃষ্টি সেই পরিকল্পনায় খানিক জল ঢালতে পেরেছিল৷ জল-জ্যাম পেরিয়ে দিল্লি থেকে রাজস্থান সীমান্তে মেওয়াট পৌঁছাতে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় ঘণ্টাতিনেক৷

আরাবল্লি পর্বতের ঠিক নীচে মেওয়াটের নুহ অঞ্চলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা ১২টা৷ ইয়াকুববকে অন্তত ১২ বার ফোন করেছি৷ কিন্তু সে ফোন তুলছে না৷ খানিক বিরক্ত হয়েই, কাদা ঠেলে ক্যাম্পের একেবারে সামনে পৌঁছানো গেল৷ রাস্তাঘাটের অবস্থা কহতব্য নয়৷ একদল তরুণ তারই মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে কার্যত রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ক্যাম্পের একশ মিটারের মধ্যে ঢোকা যাবে না৷

কেন? সাংবাদিকের বিরক্ত প্রশ্নের উত্তরে তারা জানালো, যা বলার ইয়াকুব বলবে৷ সে থানায় গেছে৷ যতক্ষণ না ফিরছে, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷

প্রায় এক ঘণ্টা বাদে ভাঙা সাইকেল চালিয়ে ফিরল ইয়াকুব৷ দৃশ্যত বিরক্ত সাংবাদিকের সামনে এসে জানালো, থানায় ঘণ্টাখানেক ধরে জেরা হয়েছে তার৷ কেন দিল্লি থেকে এক সাংবাদিক আসছে, কীভাবে তার সঙ্গে সাংবাদিকের যোগাযোগ হলো, কী কী তাকে দেখানো যাবে এই সবকিছু জানার পর থানা থেকে ছেড়েছে তাকে৷ এবং তার জন্য এতটুকু বিচলিত নয় ইয়াকুব৷ এমনটা তাদের অভ্যেস হয়ে গেছে৷ এখনও তার মনে আছে, একেবারে গোড়ার দিকে এমনই কিছু সাংবাদিক এসেছিল দিল্লি থেকে৷ ইয়াকুবরা পুলিশকে জানায়নি৷ সাংবাদিকরা ফিরে যাওয়ার পরে ইয়াকুবদের স্থানীয় থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বেধরক পেটানো হয়েছিল৷ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, থানায় না জানিয়ে ক্যাম্প থেকে যেমন কেউ বাইরে যেতে পারবে না, তেমনই বাইরের কাউকেও ঢুকতে দেওয়া যাবে না৷ সাংবাদিক হলেও৷

ক্যাম্প, না জেলখানা

জেলখানাই বটে৷ ক্যাম্পের ভিতর তৈরি হওয়া টিনের মসজিদের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে হাওয়ায় কথা ভাসিয়ে দিলেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ৷ ক্যাম্পে কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াও ঝক্কি৷ প্রথমত পুলিশকে খবর দিতে হবে৷ পুলিশ অনুমতি দিলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরিচয় দিতে হবে৷ এমনও হয়েছে, রোহিঙ্গা শুনে চিকিৎসক পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছেন৷ আর হাসপাতালে ভর্তি করা তো আরেক ঝঞ্ঝাট! পরিচয়পত্রই তো নেই! ভর্তি করার সুযোগই নেই৷

‘‘তবু সুখেই আছি৷ দিনরাত গুলি আর এনকাউন্টারের ভয় নিয়ে তো আর ঘুমোতে যেতে হয় না! মরে যাওয়ার চেয়ে এই খোলা জেলে বন্দি থাকাই শ্রেয়!'' বলে চলেছেন বৃদ্ধ৷ আশপাশ থেকে সমর্থনও মিলছে৷ মাঝ বয়সি আরেক ভদ্রলোক সঙ্গে জুড়লেন, ‘‘এনজিও-র লোকেরা এসে আশ্বাস দেয়, পরিচয়পত্র মিলবে৷ কাজের সুযোগ হবে৷ এখনও লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু কাজ তো হয়৷ সংসার চলে যায়৷''

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

বয়ান বদলে যায়

নুহ-এর ক্যাম্পের ধ্বনি দিল্লিতে অনুরণিত হয় না৷ কার্যত ফুটপাথের উপর বসে থাকা কয়েকশ মানুষের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই৷ বছরখানেক আগে উত্তরপ্রদেশ দিল্লি সীমানায় এসে একটি ফাঁকা মাঠে ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা৷ আর কিছু থাক, না থাক, মাথার উপর চালটুকু ছিল৷ এনজিও কর্মীরা এসে বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করেছিলেন৷ হঠাৎই পর পর দুইবার ওই ক্যাম্পে আগুন লেগে যায়৷ কেন লাগল, কীভাবে লাগল ভাবতে ভাবতেই আচমকা এক সকালে তারা দেখলেন, বুলডোজার নিয়ে এসে সব ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে গেছে উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন৷ সরকারি জমিতে রোহিঙ্গাদের থাকতে দেওয়া হবে না৷ দিল্লির দিকের অংশে নতুন করে বাড়ি বানানোর জায়গা নেই৷ অগত্যা রাস্তাই বেছে নিয়েছেন মানুষগুলো৷ সাংবাদিক, এনজিও কর্মী দেখলে একটিই প্রশ্ন তাদের-- ‘‘কোথায় যাব বলতে পারেন? না খেয়ে মরাই কি ভবিতব্য? এর চেয়ে জেলে থাকা ভালো৷ অন্তত দুইমুঠো খাবার আর মাথার উপর ছাদ তো মিলবে!''

জেলের কথা

খুব ভুল না হলে, ভারতে প্রথম রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল জম্মুতে৷ সেই ক্যাম্প এখন কার্যত ভেঙে পড়েছে৷ পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেছে ক্যাম্পের বহু পুরুষকে৷ বিবিধ মামলা তাদের বিরুদ্ধে৷ কোলের সন্তান নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছেন বহু নারী৷ বুকের দুধ ছাড়া সন্তানকে কিছু খাওয়ানোর নেই তাদের৷ জানেন না, এরপর কোথায় যাবেন৷ কী করবেন৷ এনজিও কর্মীরা আসেন৷ সামান্য রেশনও দিয়ে যান৷ কিন্তু তাতে আর কতদিন চলে? খাওয়াটুকু জুটে যায় তবু, ভবিষ্যতে আলো জ্বলে না৷ কেউ জানেন না, কাল কী হবে৷

বহু নারী পরিত্যক্তাও৷ হয়তো জম্মুর ক্যাম্পে নিকা হয়েছিল! সন্তান কোলে আসার পর সেই যে কাজের খোঁজে স্বামী নিখোঁজ হলেন, আর ফেরেননি৷ কাজ খুঁজতে খুঁজতে অন্য ক্যাম্পে চলে আসা পুরুষ নিকা করেছেন আবার৷ পুরনো স্ত্রীর কথা আর স্বীকারও করেন না৷ জম্মু আর নুহ ক্যাম্পে এমন নারীর সংখ্যা অনেক৷

ভারতের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা নেই, এ কথা বললে ভুল হবে৷ নিরাপত্তা আছে, এ কথাও বলা যায় না৷ জেল আর না-জেলের মধ্যবর্তী এক অনিশ্চয়তায় বেঁচে আছেন শরণার্থীরা৷ মিয়ানমারের গুলির চেয়ে যা শ্রেয়৷ এটাই তাদের কাছে নিরাপত্তার সংজ্ঞা৷