1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণপিটুনি চলছেই, আলাদা আইনের দাবি

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৯ ডিসেম্বর ২০২২

২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনু নামে এক মাকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়৷ তখন সারাদেশের মানুষ গণপিটুনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন৷

https://p.dw.com/p/4Khym
গণপিটুনির শিকার প্রায় সবাই সমাজের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর জনগণ
গণপিটুনির শিকার প্রায় সবাই সমাজের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর জনগণছবি: Mohammad Asad/picture alliance

কিন্তু সেই রেনু বেগমের পরিবার কি বিচার পেয়েছে?বন্ধ হয়েছে গণপিটুনি?

রেনু বেগমের দুই সন্তান এখন মা ছাড়াই বড় হচ্ছে৷ আর ওই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি৷ আটক আসামিদের অনেকেই জামিন পেয়েছেন৷ আর মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা কঠিন হয়ে পড়ছে৷

রেনু বেগমের ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু জানান, ‘‘এই মামলায় ১৫ জন আসামির সবাইকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল৷ কিন্তু আট জন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছেন৷ মামলাটি দুই আইনে বিচার হচ্ছে৷ হত্যা মামলা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে৷''

মামলায় এপর্যন্ত সাত জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে৷ হাইকোর্ট থেকে মামলা দ্রুত নিস্পত্তি করার আদেশ দেয়া হয়েছে৷ মামলায় মোট সাক্ষী ৩১ জন৷ সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বলেন, ‘‘মামলার সাক্ষীদের এখন আদালতে হাজির করাই বড় চ্যালেঞ্জ৷ তারা সাক্ষ্য দিতে আসতে চানা না৷ সমনও ঠিকমত হয় না৷''

গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় নিরীহদের: নূর খান

তার কথা, ‘‘রেনু হত্যার পর সবার মধ্যে যে প্রতিবাদ দেখেছি, ভেবেছিলাম এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ কিন্তু অবস্থা বদলায়নি৷ গণপিটুনিতে হত্যাও বন্ধ হয়নি৷ আর বিচারও মেলে না৷''

পরিসংখ্যান

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে রেনু যে বছর গণপিটুনিতে হত্যার শিকার হন সেই ২০১৯ সালে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হন ৬৫ জন৷ ওই বছর পদ্মা সেতুতে শিশুর রক্ত লাগবে, মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল৷ সেখান থেকেই ছেলেধরা গুজব তৈরি হয়৷ এরপর গত কয়েক বছরে এই ধরনের গুজব তৈরি না হলেও গণপিটুনি বন্ধ হয়নি৷

২০২০ সালে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন৷ চলতি বছরের থম ১০ মাসে নিহত হয়েছেন ৩১ জন৷ সবমিলিয়ে ২০১৯ সাল থেকে এপর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৫৯ জন৷ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন ঢাকা বিভাগে, ৭৪ জন৷ সবচেয়ে কম বরিশালে, চারজন৷

হাটবাজার, জনসমাগমস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এলাকায় গণপিটুনির প্রবণতা বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ কারণ ওইসব এলাকায় দ্রুত লোকজন সংগঠিত হয়৷ আর গণটিপিটুনি বেশি হয় চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও ছেলেধরা সন্দেহে৷

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘একধরনের অপবাদ দিয়েও পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়৷ কারণ এতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন৷ যাদের গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় তাদের অধিকাংশই নিরপরাধ ও নিরীহ৷ আজকাল ধর্মকে ব্যবহার করেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে৷''

অনেক গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা আলোচনায় আসে না: ইশরাত হাসান

তবে কোনো একটি অপরাধমূলক ঘটনা ঘটনার পর দায়ী ব্যক্তিকে হাতেনাতে ধরে ফেলার পর উত্তেজিত জনতা পুলিশে না দিয়ে গণপিটুনি শুরু করে৷ এমনকি পুলিশও গণপিটুনির শিকার হওয়ার অনেক ঘটনা আছে৷

কারা শিকার, কেন শিকার?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী বাংলাদেশ ও ভারতে গণপিটুনির বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন৷ তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশে গণপিটুনির শিকার প্রায় সবাই সমাজের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর জনগণ এবং প্রতিবন্ধী নারী৷''

তার কথা, ‘‘গণপিটুনি এবং সামাজিক সহিংসতার জন্য মানুষের নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিষ্ক্রিয়তা প্রধানভাবে দায়ী৷''

রাজীব নন্দী বলেন, ‘‘গণপিটুনির সাম্প্রতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুটি নৃশংস ঘটনা ঘটেছে৷ এক নারীকে গাড়ি চাপা দিয়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং গাড়ির চালককে গণপিটুনি দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে৷ বিচারহীন সমাজে মানুষ এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করছে৷ দুটো ঘটনাই নিন্দনীয়৷ অথচ আমাদের এটাও চিন্তা করার অবকাশ আছে যে, জনরোষের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলেই গাড়ির চালক নৃশংসতার সাথে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছেন৷ আবার এটাও অমূলক নয় যে, গাড়ি চাপার কারণেই জনরোষ বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে কিনা৷''

মব সাইকোলজি কেন?

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘‘মানুষের ভেতর বিচার ও প্রতিকার পাওয়ার প্রবণতা থেকে মব সাইকোলজি কাজ করে৷ আর এটা যখন তার মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে তখন তার বিবেচনা বোধ থাকে৷ বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা লোপ পায়৷ তখন একজন নিরীহ বা শিক্ষিত লোকও গণপিটুনি বা হত্যায় অংশ নিতে পারে৷''

তিনি কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রাইভেট কারের চাকায় পিস্ট হয়ে একজন নারীর মৃত্যু এবং তাকে অনেক দূর টেনে নেয়ায় চালক সাবেক অধ্যাপককে গণপিটুনির বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এখানে নির্মমতার মাত্রা ওই এলাকার মানুষকে মবে পরিণত করেছে৷ তারা কয়েকজন হয়ত তাৎক্ষণিক বিচার করতে চেয়েছেন৷ তাদের এই প্রবণতা অন্যদেরও মবে পরিণত করেছে৷ তবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সুযোগ-সন্ধানীরাও থাকে৷ তারা ঘটনা শুরু করে কেটে পড়ে৷''

গণপিটুনির ঘটনায় ৮ জন জামিনে মুক্ত: রেনুর আত্মীয়

তার কথা, ‘‘মানুষ ন্যায়বিচার চায়৷ বিচার ব্যবস্থা যখন আস্থার জায়গা তৈরিতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষ নিজের হাতেই বিচার করতে চায়৷ সে ভাবে ছেড়ে দিলে বিচার আর হবে না৷''

এরজন্য ন্যায়বিচার ব্যবস্থা এবং আস্থাশীল পুলিশিং সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন এবং মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে৷

নূর খানও মনে করেন প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা মানুষকে আইন হাতে তুলে নিতে প্রলুব্ধ করে৷ আর গণপিটুনির ঘটনায় বিচার হয় না বলে তারা আইন হাতে তুলে নেয়ার সাহস করে৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত আলোচিত গণপিটুনির মামলাগুলোর বিচার হতে আমরা দেখিনি৷ আর অনেক গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনাতো আলোচনায়ই আসে না৷ বিচার তো দূরের কথা৷''

তিনি বলেন, ‘‘ফলে সমাজে একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে এবং কেউ কেউ গণপিটুনিকে সঠিক মনে করেন৷''

মব সম্পর্কে রাজীব নন্দী বলেন, ‘‘জনতার ভিড়ে ব্যক্তির ব্যাক্তি সত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটে এবং প্রতিজন ব্যক্তি মিলে উত্তেজিত জনতার সমষ্টি তৈরি হয়৷ জনতার ‘সম্মিলিত মন' তখন বিপদজনক সিদ্ধান্ত নেয়৷ আক্রমণমুখী জনতার হিংস্রতা থেকেই মবলিঞ্চিং এর উৎপত্তি৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ও ভারতে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির ঘটনার কোনো বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি৷''

আইন কী বলে?

বাংলাদেশে গণপিটুনিতে হত্যার বিচারের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই৷ প্রচলিত আইনেই মামলা ও বিচার হয়৷ ফলে এই মামলায় অপরাধী সনাক্ত, বিচারের আওতায় আনা এবং সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান৷ তিনি বলেন, ‘‘গণপিটুনিতে শত শত মানুষ অংশ নেয়৷ তাই সেটা প্রমাণ করা কঠিন যে এর পিছনে কারা ইন্ধন দাতা, কারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন৷ যেহেতু এটা ‘মবে' তাই অনেক নিরীহ মানুষও ক্ষণিকের উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়ে৷ তাই যে এলাকায় ঘটনা ঘটে তাদের প্রবণতা থাকে জড়িতদের রক্ষা করা৷ ফলে সাক্ষী পাওয়া যায় না৷ আর আমাদের ফৌজদারি আইনের বিধান হলো, শতভাগ সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করে অপরাধ প্রমাণ করা৷''

তাই গণপিটুনির মতো অপরাধ বন্ধে বাংলাদেশে নতুন আইন হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন৷ আইন না হওয়া পর্যন্ত রেনু হত্যার পর উচ্চ আদালত যে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তা মেনে চলা উচিত বলে মনে করেন তিনি৷ কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না৷ তাই গণপিটুনিও কমছে না৷

উচ্চ আদালত পাঁচ দফা নির্দেশনায় বলেছিলেন-

১. পুলিশের প্রত্যেক সার্কেল অফিসার তার অধীনের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ছয় মাসে অন্তত একবার গণপিটুনি প্রবণতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে বৈঠক করবেন৷

২. গণপিটুনির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রচার কার্যক্রম গণমাধ্যমে প্রচারণা অব্যাহত রাখবে৷

৩. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের অডিও, ভিডিও, মেসেজ যা গুজব সৃষ্টি বা গণপিটুনিতে মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷ যে দুষ্কৃতকারীরা এ কাজে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷

৪. যখনই গণপিটুনির কোনো ঘটনা ঘটবে, কোনো রকম দেরি না করে তখনই থানার ওসি এফআইআর নিতে বাধ্য থাকবেন এবং তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারকে অবহিত করবেন৷

৫. গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম হত্যার ঘটনায় ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তর বাড্ডা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অবহেলার ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন৷

এই পাঁচ নির্দেশনার প্রথম চারটি সার্বিক৷ কিন্তু একটিও বাস্তবায়ন হয়নি৷ ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো৷'' আর নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশই আইন বলে তিনি জানান৷ তবে ভারতে গণপিটুনির বিচারে আলাদা আইন আছে৷