1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
সমান অধিকারবাংলাদেশ

খেলার পথে এগিয়ে যেতে নারীর বাধা

শাহনাজ মুন্নী
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিজয়কেতন উড়িয়ে, পুস্প বিছানো পথে, বীরের বেশে দেশে ফিরলো সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল৷ এই সাফল্য অবশ্যই আনন্দের, উদযাপনেরও বটে৷

https://p.dw.com/p/4HFqJ
ফুটবলে খেলছেন কয়েকজন তরুণী
ফুটবলে খেলছেন কয়েকজন তরুণীছবি: Mir Farid

কিন্তু একটু পেছন ফিরে তাকালেই চোখে পড়বে তাদের কাঁটা ও কাঁচের টুকরা বিছানো পথের ছবি, যেখানে হয়তো একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে এই মেয়েদের রক্ত মাখা পায়ের ছাপ৷

কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশে সাধারণের মনোজগতে ফুটবলকে দেখা হতো, ‘পুরুষের খেলা’ হিসেবে৷ মেয়েরা মাঠে গিয়ে বল খেলবে- এটা ছিল রীতিমতো ট্যাবু- নিষিদ্ধ ব্যাপার৷ ২০০৩, ২০০৪ সালের দিকে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধ করতে মৌলবাদি শক্তি শ্লোগান দিয়ে, মিটিং মিছিল করে বাঁধাতো দিয়েছিলই, এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতেও দ্বিধা করেনি৷ খেলাধুলাকে বলা হয়েছে, মেয়েদের স্বভাব, স্বাস্থ্য ও মর্যাদার পরিপন্থি৷ মেয়েরা ঘরে থাকবে, লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন কাটাবে- এই ছিল তাদের বিধান৷  

২০১১ সালে সরকারিভাবে দেশ জুড়ে প্রাথমিক স্কুলের মেয়েদের জন্য চালু করা হয় বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্ট৷ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় তখন আর কোন পক্ষের বিরোধিতাই ধোপে টিকেনি৷ সেই টুর্নামেন্ট ঘিরেই বলা চলে, আজকের তরুণী আর তখনকার কিশোরীদের ফুটবল যাত্রা শুরু৷ সানজিদা, মারিয়া, সাবিনা, মণিকারা নানা বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সেই পথ ধরেই জোর কদমে সামনে এগিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য ট্রফি জিতেছেন৷ 

তবে খেলার জগতে মেয়েদের পা রাখাটা কিন্তু খুব সহজ নয়৷ আমাদের সমাজে মেয়েদের প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে, খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবারের সদস্যরাই৷ পরিবার নিরুৎসাহিত করলে একা একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধূলা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ পরিবার বাধা দেয় মূলত সমাজের চোখ রাঙানি, প্রতিবেশিদের তিরস্কার, ধর্মীয় বাধা নিষেধের ভয় ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে৷ অসংখ্য মানুষের সামনে মেয়েরা হাফপ্যান্ট, জার্সি পড়ে খেলবে, ছুটবে, দৌড়াবে-  পরিবার ও সমাজের অভিভাবকরা তা মানতে পারেন না৷ ফলে যে মেয়েরা মাঠে খেলতে নামে তাকে ও তার পরিবারকে পদে পদে সহ্য করতে হয় সমাজের কটু কথা, টিপ্পনি, ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ, গঞ্জনা ও অপবাদ৷ নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ সমাজ এখনো স্বাভাবিকভাবে সমর্থন তো করেই না বরং নানাভাবে খেলাধুলা বন্ধ করার চেষ্টা চালায়৷ তাছাড়া অনেক পরিবার মনে করে, খেলাধুলা করলে রোদে বৃষ্টিতে মেয়েদের চেহারার স্বাভাবিক শ্রী নষ্ট হয়ে যাবে৷ তখন বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে৷ কেননা, এখনও বিশ্বাস করা হয়, বিয়ে করে বাচ্চা লালন পালন করাই নারীদের নিয়তি৷ তাদের স্থান অবশ্যই ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে, বাইরের দুনিয়ায় নয়৷

বাংলাদেশের নারীদের সংগ্রাম তো অন্তহীন৷ ঘরে বাইরে পরিবারে সমাজে জীবনের সর্বত্র বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে তাদের সামনে এগুতে হয়৷ সমাজ সংস্কারের পিছুটান, পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গী, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ নারীদের পায়ে শিকল পরিয়ে পেছন দিকে টানতে সদা তৎপর৷ আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি, এই কিছুদিন আগেও ‘পোষাক বিতর্ক’ তুলে নারীর স্বাধীন চলাফেরা ও পোষাকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে৷ তথাকথিত ‘ছোট কাপড়’, ‘বড় কাপড়’ নিয়ে মন্তব্য, পাল্টা মন্তব্যের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়৷ যেখানে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে বলা হয়, সেখানে ফুটবলার মেয়েদের খেলার উপযোগী ছোট প্যান্ট, ওড়না ছাড়া জার্সি পরা এক শ্রেণীর মানুষ কোন চোখে দেখতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ পোশাকের প্রতিবন্ধকতা যে এখনো খেলাধুলায় মেয়েদের অংশ নিতে কুণ্ঠিত করে রাখে, তা বলাই বাহুল্য৷ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় মেয়েদের খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি৷ খেলার মাঠ তো নেই-ই, নেই তেমন প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার সুযোগ'ও৷ ফলে ক্রীড়াঙ্গনে নারীর উপস্থিতি বরাবরই খুব কম৷ বাংলাদেশে ক্ষমতায়নের পথে নারীর অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও গণ পরিবহনে, রাস্তায় নারীর চলাচল এখনো নিরাপদ নয়৷ এমনকি ঘরেও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন প্রায় ৮৩ শতাংশ নারী৷ বিশ্বে বাল্য বিবাহের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ অন্যতম৷ ফলে মেয়েরা খেলার মাঠে থাকবে কি করে, আঠার বছর বয়সের আগেই তাকে সংসারের মাঠ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়৷  

এমন বাস্তবতায় আমাদের নারী ফুটবলাররা এক অর্থে দুঃসাহসিক কাজই করেছেন বটে৷ সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেও যেন প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তারা৷ সানজিদা তার ফেসবুক ষ্ট্যাটাসে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘এই দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে৷ আমরা জীবন যুদ্ধে লড়ে অভ্যস্ত৷’’ সত্যিই তাই৷ বাংলাদেশের এই নারীরা যেমন মাঠে লড়েছেন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তেমনি পায়ে পায়ে লড়েছেন পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে৷ আরেকটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, এই দলে যে মেয়েরা খেলছেন তারা বেশিরভাগই উঠে এসেছেন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে এবং তাদের অনেকেই সামাজিক অবস্থানে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য৷ অর্থাৎ তারা একে তো নারী, তার উপর দরিদ্র৷ ফলে তাদের কাঁধে চেপে বসা বোঝার ভার আরো বেশি, তাদের লড়াই আরো কঠিন৷ একদিকে সামাজিক হেনস্তা অন্যদিকে কঠিন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে জীবন জীবিকার জন্য যুদ্ধ করে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে৷ এই মেয়েদের অনেকের আয়েই হয়তো তাদের সংসার চলে৷ কিন্তু তাদের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রেও রয়েছে চরম বৈষম্য৷ একজন পুরুষ ফুটবল খেলোয়াড়ের চাইতে নারী ফুটবলারের পারিশ্রমিক অনেক কম৷ নারী খেলোয়ারদের জন্য নানা রকম পুরস্কার প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে গেলেও পারিশ্রমিকের এই ব্যবধান ঘুচিয়ে সমতা আনার কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না৷ ছাদখোলা বাসে প্রাণঢালা সম্বর্ধনার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকে এই দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে৷

শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিক
শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিকছবি: privat

বাংলাদেশে নারী খেলোয়াড়দের টুর্নামেন্ট আয়োজনে বা পৃষ্ঠপোষকতায় বড় কোন বাণিজ্যিক সংস্থাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না৷ আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং বা সাফল্যের বিচারে ক্রিকেট ফুটবল দুই ক্ষেত্রেই নারীদলের অবস্থান পুরুষদলের চাইতে অনেক সন্তোষজনক হলেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই তারা কর্পোরেট দুনিয়াতেও অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার৷ ফলে সমান পরিশ্রম করেও পেশাদার খেলার জগতে আর্থিকভাবে নারী খেলোয়াড়রা পিছিয়েই থাকছে৷ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারলে মেয়েদের মর্যাদার সাথে ক্রীড়াঙ্গণে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে৷

সাফ পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নশীপ ছিনিয়ে আনা নিঃসন্দেহে গৌরবের আরো গৌরব সমস্ত প্রতিকূলতাকে ঠেলে স্রোতের বিপরীতে নিরন্তর এগিয়ে চলা৷ দুর্জয় সাহস আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছে যে নারীরা তাদের জয় হোক৷ তাদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে আসুক আরো অনেকে৷