কাগজের অস্বাভাবিক চাহিদা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে
২৭ মে ২০১১কাগজের ব্যবহার বাড়ছে
১৯৫০ সালের তুলনায় আজ কাগজের ব্যবহার প্রায় ৭ গুণ বেড়ে গেছে৷ সেই কাগজের যোগান দিতে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বনজঙ্গল, যা টিউনিশিয়ার মতে দেশের আয়তনের প্রায় সমান৷ বেড়ে চলেছে এমন সব গাছপালার প্লান্টেশন বা বাগান, যা দিয়ে কাগজের মণ্ড তৈরি করা যায়৷ অথচ গাছের কাঠ থেকে নতুন কাগজ তৈরি না করে পুরানো কাগজের রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহার করলে পরিবেশের অনেক কম ক্ষতি হয়৷
১৯৮০র দশকে যখন ইন্টারনেট ও ই-মেলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তখন সবাই মনে করেছিল, এবার হয়তো অফিস-আদালতে কাগজের ব্যবহার অনেক কমে যাবে৷ অথচ বাস্তবে তেমনটা হয় নি, যেমনটা বলছিলেন জার্মানির পরিবেশ কল্যাণ দপ্তরের কর্মকর্তা আলমুট রাইশার্ট৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা দপ্তরে আরও বেশি কাগজ ব্যবহার করছি, কারণ আজকাল দ্রুত প্রিন্ট নেওয়া অতি সহজ৷ বোতামে কয়েকবার চাপ দিলেই কয়েক'শো পাতার প্রিন্ট নেওয়া যায়৷ আগে এমনটা ছিল না৷ একটি কাগজই সবার হাতে হাতে ঘুরতো৷''
শিল্পোন্নত দেশগুলি তালিকার শীর্ষে
এই পরিস্থিতি যে নিছক আনুমানিক নয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ইউরোপে চালানো এক সমীক্ষা, যার পোশাকি নাম ‘ইন পেপার উই ট্রাস্ট' – অর্থাৎ কাগজের উপরেই আমাদের আস্থা রয়েছে৷ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করা সত্ত্বেও অনেকেই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে তার একটা প্রিন্ট নিয়ে রাখেন৷
আরও দেখা গেছে, যে অর্থনৈতিক সংকট ঘটলে কাগজের চাহিদা কমার বদলে বেড়ে যায়৷ গোটা বিশ্বে ৪টি দেশ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও জার্মানিতে কাগজের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি৷ জার্মানিতে কাগজ ব্যবহারের মাথাপিছু বাৎসরিক হার প্রায় ২৩০ কিলোগ্রাম – যা গোটা বিশ্বের গড় হারের তুলনায় প্রায় ৪ গুণ বেশি৷ আলমুট রাইশার্ট এপ্রসঙ্গে বললেন, ‘‘এশিয়া ও আফ্রিকা সম্মিলিতভাবে যত কাগজ ব্যবহার করে, জার্মানি একাই তার থেকেও বেশি কাগজ ব্যবহার করে৷ জনসংখ্যার বিচারেও এই প্রবণতা বিস্ময়কর৷ এভাবে কাগজের চাহিদা আরও বাড়তে থাকলে শুধু কাগজের মণ্ড দিয়ে তা পূরণ করা যাবে না৷ তাই পুরানো কাগজের পুনর্ব্যবহার ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই৷''
পুরানো কাগজই বিকল্প কাঁচামাল
গাছ থেকে বানানো কাগজের মণ্ডের পাশাপাশি পুরানো কাগজও নতুন কাগজের কাঁচামাল হিসেবে আরও বেশি কাজে লাগানো হচ্ছে৷ একমাত্র পণ্যের মোড়ক হিসেবে এর ব্যবহার চলে না৷ পরিবেশ সংরক্ষণের দিক থেকে দেখলে কাঁচামাল হিসেবে পুরানো কাগজের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে৷ কারণ তার মধ্যে আগে থেকেই ফাইবার বা তন্তু রয়েছে – তা শুধু বের করে নিলেই হলো৷ কাঠের মধ্য থেকে এই তন্তু বের করে নিতে হলে নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে হয়৷ এই প্রক্রিয়ার জন্য বিশাল পরিমাণ জ্বালানি ও জলেরও ব্যবহার করতে হয়৷ প্রক্রিয়ার শেষে বর্জ্য হিসেবে যে জল নিকাশি ব্যবস্থায় বেরিয়ে যায়, তাও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক৷
পুরানো কাগজ থেকে নতুন কাগজ তৈরির পক্ষে আরও যুক্তি রয়েছে৷ হিসেব করে দেখা গেছে, কাঠ থেকে কাগজের মণ্ড তৈরি করার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ৩ থেকে ৪ গুন বেশি জ্বালানি এবং ৫ গুণ বেশি জলের প্রয়োজন হয়৷ বর্জ্য হিসেবে যে জল বেরোয়, তাও এক-চতুর্থাংশ বেশি৷ তার উপর কাগজ তৈরি করতে তুলনামূলকভাবে বিশাল পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন হয়৷
চাহিদার চাপে জিনগত পরিবর্তন
কাগজ তৈরির জন্য কাঠের বেড়ে চলা চাহিদার পরিণাম ভয়াবহ৷ কাঠের অন্যান্য ব্যবহারের সঙ্গে এই বাড়তি চাহিদা যোগ হওয়ার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে৷ হারিয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চল৷ তাছাড়া শুধু যে গাছ কাটা হচ্ছে তাই নয়, সেইসঙ্গে জঙ্গলের স্বাভাবিক গাছপালা ধ্বংস করে খালি জায়গায় লাগানো হচ্ছে শুধু এমন সব গাছ, যা দ্রুত বেড়ে উঠবে এবং যা থেকে কাগজ তৈরির উপযোগী তন্তু পাওয়া যাবে৷ এমনকি জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সব গাছের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করা হচ্ছে, বাড়ানো হচ্ছে তন্তুর পরিমাণ৷ কৃত্রিম উপায়ে বনাঞ্চলে এই পরিবর্তনের ফলে সেই সব এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে৷ যেমন সুমাত্রা দ্বীপের বিখ্যাত ‘রেন ফরেস্ট' এই প্লান্টেশনের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, জিনগত উপায়ে পরিবর্তিত গাছপালা আস্তে আস্তে আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে, যার কুফল সম্পর্কে আমাদের আজ কোনো স্বচ্ছ ধারণাই নেই৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আরাফাতুল ইসলাম