1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ওপেন সিক্রেট: অপরাধী পলায়নের পাটিগণিত

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
২৫ নভেম্বর ২০২২

ভারতে আদালতচত্বরে অনেক দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটেছে৷ অভিযুক্ত খুন হয়েছে৷ অপরাধীরা পালিয়েছে৷ দিল্লি-সহ বিভিন্ন রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷

https://p.dw.com/p/4K2iC
দিল্লির রোহিনিতে জেলা আদালতের প্রবেশমুখে মেটাল ডিটেক্টর বসানো আছে।
দিল্লির রোহিনিতে জেলা আদালতের প্রবেশমুখে মেটাল ডিটেক্টর বসানো আছে (ফাইল ছবি)ছবি: Money Sharma/AFP

বছরখানেক আগের কথা৷ দিল্লির রোহিনিতে আদালতকক্ষে কুখ্য়াত গ্য়াংস্টার জিতেন্দ্র মান ওরফে গোগির বিচার চলছে৷ সেসময় আইনজীবীর ছদ্মবেশধারী দুই অপরাধী আদালতে ঢুকে গোগিকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে৷ মোট দশটি গুলি তারা গোগিকে লক্ষ্য করে চালায়৷ সাতটি গুলি তার গায়ে লাগে৷ পুলিশের গুলিতে দুই বন্দুকধারী মারা যায়৷ 

এই ধরনের দৃশ্য সাধারণত বলিউডের ছবিতে দেখা যায়৷ গ্যাং ওয়ারের দৃশ্য৷ তারা নতুন নতুন পদ্ধতিতে একে অন্যকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করে৷ তাই বলে দিল্লির মতো জায়গায় আদালতকক্ষে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে? এ তো উত্তরপ্রদেশের জেলার কোনো ছোট আদালত বা পশ্চিমবঙ্গের কোনো মহকুমার আদালত নয়৷ একেবারে রাজধানীর আদালত, যেখানে সবসময় প্রচুর নিরাপত্তা থাকে৷ মেটাল ডিটেক্টরের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে হয়৷ সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকে৷

দিল্লির এই ঘটনা নিয়ে হইচই কম হয়নি৷ হাইকোর্টে মামলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে নোটিশ দিয়েছে৷ কারণ, পুলিশ এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে৷ কেন্দ্র তার জবাবে নিরাপত্তা নিয়ে নানা কথা বলেছে৷ তবে ইন্ডিযান এক্সপ্রেসকে এক সাবেক ডিআইজি বলেছিলেন, মেটাল ডিটেক্টর কাজ করেনি৷

মেটাল ডিটেক্টর কাজ না করলেও পুলিশি তল্লাশি আছে৷ সেখানেও ধরা পড়েনি অস্ত্র নিয়ে আদালতে ঢুকছে আইনজীবীর ছদ্মবেশে দুই অপরাধী৷ সুপ্রিম কোর্টে যেমন আইনজীবীদের জন্য বিশেষ কার্ড আছে৷ তারা সেই কার্ড সোয়াইপ করে মেটাল ডিটেক্টর পার হন৷ অন্য আদালতে সেই ব্যবস্থা কোথায় থাকে? তাই প্রতিপক্ষকে আদালতকক্ষে ঢুকে মারার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারে বিপক্ষ ডনের অনুগামীরা৷

অথচ, এই রোহিনি আদালতেই চার বছরে পাঁচবার গুলি চলেছে৷ গোগির ক্ষেত্রে গুলি চলেছিল আদালতকক্ষের ভিতরে৷ অন্যবার চলেছে আদালত চত্বরে৷ গত এপ্রিলেও চলেছে৷ তবে সেবার আইনজীবীদের দুই গোষ্ঠীর মারামারি থামাতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল৷

রোহিনিতে তো তাও পুলিশ গুলি করে বন্দুকধারী অপরাধীদের মেরেছিল৷ কিন্তু উত্তরপ্রদেশের হাপুরে আদালত চত্বরের ঠিক বাইরে গত অগাস্ট মাসে একজন বিচারাধীন বন্দিকে মেরে দুই অপরাধী পালিয়ে গিয়েছিল৷ ওই বিচারাধীন বন্দিকে হরিয়ানা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল৷ আলাদত চত্বরে পুলিশ ছিল৷ তাও ওই ঘটনা ঘটে৷

উত্তরপ্রদেশের বিজনোরে হত্য়ার দায়ে অভিযুক্ত একজনকে আদালতকক্ষের ভিতরে গুলি করে মারা হয়৷ দুইজন পুলিশও আহত হয়৷ আর এই সুযোগে একজন হত্য়ার দায়ে অভিযুক্ত পালিয়ে য়ায়৷ এরপর ১৮ জন পুলিশ কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল মাত্র৷ কারণ, তারা তাদের কাজ করেনি৷ আদালতকক্ষে ঢোকার আগে ঠিকভাবে চেকিং হয়নি৷

আসলে এরকম ঘটনা ঘটে, তারপর সরকারি কর্মী ও পুলিশের নামমাত্র শাস্তি হয়৷ দুই-এক দিন মিডিয়ায় সোরগোল হয়৷ তারপর আবার যে কে সেই৷ শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশরা আবার কবে ডিউটিতে যোগ দেন, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না৷ শুধু এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয়, অপরাধীদের হাত কতটা লম্বা৷ এনিয়ে বলিউডের প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া ডায়লগ তো আছেই, ডনকো পাকড়না, মুসকিলই নেহি, নামুমকিন হ্যায়৷ ডলকে ধরা সত্যিই অসম্ভব৷ আর তারা চাইলে কী না করতে পারে! আদালতকক্ষের ভিতরে গিয়ে প্রতিপক্ষকে মারা তো জলভাত৷ 

এটা মনে করলে ভুল হবে যে, আদালতকক্ষে গুলির ঘটনাগুলি সাম্প্রতিককালের ঘটনা৷ ২০১৫-তেও দিল্লির করকরডুমা আদালতে গুলি চলেছে৷ একজন পুলিশ-সহ তিনজন আহত হয়েছেন৷ দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বলা যেতে পারে, এই ঘটনা আগেও ঘটত, এখনো ঘটছে৷

২০০৯ সালে জলপাইগুড়ির ঘটনা তো চমকপ্রদ৷ আদালতে নিয়ে আসা হয়েছে ছয়জন বিচারাধীন বন্দিকে৷ একজন জল চেয়েছে৷ তাদের জল দিতে গিয়ে যেই দরজা খোলা হয়েছে, তখনই ছয়জন বন্দি পালিয়েছে৷ ভরা আদালতে সকলের চোখের সামনে দিয়ে তারা পালিয়ে গেল৷ তবে পুলিশও দৌড়েছিল ধরার জন্য৷ কিন্তু তাদের দৌড়ের গতি এতটাই খারাপ ছিল যে, বন্দিদের পালাতে কোনো অসুবিধা হয়নি৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

২০১১ সালে কলকাতায় ব্য়ারাকপুরে একজন বিচারাধীন বন্দির জামিন নাকচ হয়ে যায়৷ তাকে নিয়ে দুইজন পুলিশ আলাদতকক্ষ থেকে ভ্যানের দিকে যাচ্ছিল৷ তখন হাতকড়া পরা অবস্থায় সেই বন্দি একজন পুলিশকে ধাক্কা মারে৷ সেই পুলিশই তাকে হাতকড়া ধরে নিয়ে যাচ্ছিল৷ তারপর সে দৌড়ে পালিয়ে য়ায়৷ যথারীতি পুলিশ ছুটে তার নাগাল পায়নি৷

পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, ভোপাল সবজায়গায় গল্পগুলো একইরকম৷ খালি চরিত্রের নাম বদলে য়ায়৷ পালানোর বা মারার পদ্ধতিটা বদলে যায়৷ বাকি চিত্রনাট্য একই থাকে৷ ভারতে একটা চালু কথা আছে৷ পুলিশ চাইলে সবকিছু করতে পারে৷ কলকাতা ময়দানে বইমেলা চত্বর থেকে বাড়ির চাবি পর্যন্ত উদ্ধার করে দিতে পারে৷ তবে সেটা কর্তার হয়৷ এও বলা হয়, পুলিশ নাকি সব জানে৷ কে কোথায় কী কীর্তি করেছে বা করবে, সবই তাদের নখদর্পনে থাকে৷ তা সত্ত্বেও তারা অনেক সময়ই কিছু করে না৷ বিশেষ করে প্রভাবশালী না হলে, পুলিশ করবেই বা কেন?

সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা কে কবে ভেবেছে? তারা তো বাঁচে ভগবান ভরসায়৷ আর অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ বলে, অপরাধীদের অগম্য কোনো জায়গা নেই৷ তাই ডনরা আদালতকক্ষে গিয়ে পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে মারবে, বন্দিকে ছিনিয়ে আনবে এ তো সহজ কথা৷ এসব তো রকেট সায়েন্স নয়৷ কে যে কীসে বশ, তা তাদের থেকে ভালো আর কে জানে৷ ফলে এই ধরনের ঘটনা হচ্ছে-হবে, চলছে-চলবে৷ সাংবাদিকরা একটু হইচই করবে৷ কিন্তু কে না জানে, জনগণের স্মৃতিশক্তি খুবই কম৷ তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে, বেঁচে থাকার তাগিদ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, চোখের সামনে রাজনীতি-অপরাধজগত-প্রশাসনতন্ত্রের যোগও তারা দেখতে পায় না৷ অথবা, দেখলেও তাদের কিছু করার নেই৷