একসঙ্গে থাকা মানে ছুঁয়ে থাকা
২৮ আগস্ট ২০২০কোভিড লকডাউন৷ সামাজিক দূরত্ব৷ জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় বেরোলেও পাশের লোকটির সঙ্গে অন্তত ছয় ফুটের নিরাপদ ব্যবধান৷ মুখে মুখোশ, মাথা ঢাকা, হাতে দস্তানা৷ ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত হয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া৷ এই আতঙ্কের আবহে সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক আসর, এমনকি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সমাবেশও বন্ধ হয়ে আছে গত পাঁচ-ছয় মাস৷ এর পাশাপাশি যা দৈনন্দিন যাপনের অঙ্গ ছিল, যা কিছু স্বাভাবিক ছিল, যেমন পাড়ার চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে জমিয়ে বসে আড্ডা, বা বন্ধুর বাড়ি বসে খোশগল্প, সেসবও বন্ধ৷ নিজেদের নিরাপদ রাখতে গিয়ে এই সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নির্জন দ্বীপের মতো বসে থেকে কী পাচ্ছি আমরা, কীইবা হারাচ্ছি? সমসময়ের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এক অভিনব কর্মসূচি নিয়েছে গ্যোটে ইনস্টিটিউট কলকাতা৷ ‘কন্টেজিয়ান’ শীর্ষক এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য, বহু জনের একত্র হওয়ার ভালো দিকগুলো চিহ্নিত করা৷ এবং আগামী আরও এক বছর যদি বাস্তবে মেলামেশা, কথাবার্তার বদলে এই ভার্চুয়াল মোলাকাতেই অভ্যস্ত হতে হয়, তা হলে সেই ভালো দিকগুলো এই ডিজিটাল বিনিময়েও আনা যায় কিনা, সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা৷
গ্যোটে ইনস্টিটিউটের উৎসাহে আয়োজিত এই ‘কন্টেজিয়ান’ কর্মসূচির মূল পরিচালক যিনি, সেই বিক্রম আয়েঙ্গার ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘এখন যে সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, অনেক কিছু আমাদের বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ অনেক কিছু আমাদের অন্যভাবে ভাবতে হচ্ছে নতুন করে৷ এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে আর্ট সেক্টরটা, বিশেষ করে পারফর্মিং আর্টস সেক্টর, যেমন থিয়েটার, ডান্স, এই জাতীয়, যেখানে লাইভ অডিয়েন্স খুবই জরুরি, সেটা করাই যাচ্ছে না৷ এরকম একটা সিচুয়েশনে আমরা লাইভ এক্সপেরিয়েন্স বলতে যেটা বুঝি, যে কোনও লাইভ এক্সপিরিয়েন্স, (কেউ) কোনও একটা মিটিংয়ে যাচ্ছে, কোনও একটা পার্টিতে যাচ্ছে, কোনও রক কনসার্টে যাচ্ছে— যে কোনও লাইভ এক্সপেরিয়েন্স কিন্তু আমাদের এক্সপেরিয়েন্স থেকে (এখন) বাতিল৷ আমরা করতেই পারবো না৷ এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা সবাই হয়ত এক্সপেরিয়েন্স করছি একটা ডিসকানেক্ট৷’’
সেই বিচ্ছিন্নতার বোধ থেকেই এই প্রকল্প শুরু করেছেন বিক্রম আয়েঙ্গার৷ তাঁর বক্তব্য, মানুষে মানুষে যদি নিয়মিত সংযোগ থাকে, তা হলে রোগজীবাণু সংক্রমণ ছাড়াও তো আরও অনেক কিছু ছড়ায়৷ যেমন চিন্তার বিনিময় হয়, বিতর্ক হয়, মতবিরোধ হয়, তার মধ্যে থেকে নতুন ধারণা উঠে আসে৷ অথবা নাটক, নাচ, গানের মতো পারফরমিং আর্টসের ক্ষেত্রে শিল্পী এবং তাঁর শিল্পের সঙ্গে দর্শকের সরাসরি সংযোগ গড়ে ওঠে৷ সেই অভিজ্ঞতা, তার থেকে পাওয়া যে শিক্ষা, সেই সব নিয়েই আলোচনা করবেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা বহু বিশিষ্টজন৷ একই সঙ্গে তাঁরা এই বিচ্ছিন্নতার সংকট থেকে উত্তরণেরও পথ খুঁজবেন৷ ভারতীয় থিয়েটারের অন্যতম মুখ রত্না পাঠক শাহ অংশ নিচ্ছেন এই আলোচনায়, আছেন প্রখ্যাত থিয়েটার তাত্ত্বিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ গেমপ্ল্যান বলে যে সংস্থা কলকাতা লিটারারি মিট ‘কলম’–এর মূল উদ্যোক্তা, তার তরফে আছেন মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাংলাদেশ থেকে আছেন নৃতত্ত্ববিদ নুসরাত চৌধুরি, যিনি জনসমাবেশের ব্যবহারিক ধরন-ধারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং তিনি বলবেন, জমায়েত আসলে কত রকমভাবে মানবচরিত্রের গঠন এবং বিকাশে কাজে লাগে, সে নিয়ে৷
ডিজিটাল জগতে থাকতে ক্রমশ অভ্যস্ত হতে থাকা মানুষজন আসলে কতটা মিস করছে বাস্তবের অভিজ্ঞতাকে?ঠিক কোন বিষয়গুলো তাদের অস্বস্তিতে রাখছে? সেটাও খুঁজতে চান বিক্রম৷ বললেন, ‘‘কেন আমাদের গ্যাদারিংটা নেসেসারি, অ্যাজ এ হিউম্যান নিড, টু কাম টুগেদার অ্যাজ এ হিউম্যান নিড— সেটা কেন? ওই প্রশ্নটা দিয়ে আমরা শুরু করছি৷ তার পর চলে যাচ্ছি পারফর্মিং আর্টস সেক্টরের মধ্যে আরও স্পেশাল কী হয়? ডিজিটালি আমরা সেটা দেখতেই পারি৷ কিন্তু লাইভ এক্সিপেরিয়েন্সের স্পেশালিটি কী, যেটা আমরা ডিজিটাল এক্সপেরিয়েন্সে পাবো না? আর থার্ড কোয়েশ্চেন, এখন আমরা এখান থেকে কীভাবে এগোব?’’
কাজেই ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুর হচ্ছে এই ভারচুয়াল কথোপকথন, আটটি পর্বে, যা চলবে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত৷ খোঁজা হবে যোগাযোগের, পরস্পরকে চিন্তাগতভাবে ছুঁয়ে থাকার নতুন পথ৷