এই শিষ্টাচারটুকু অন্তত থাক
২৬ নভেম্বর ২০২১সরকারের বদল হতেই ভয় পেয়ে গেছিলেন কংগ্রেস নেতারা৷ চিন্তাটা ছিল প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির চিকিৎসা নিয়ে৷ প্রিয়রঞ্জন তার আগে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ৷ ব্রেন ডেড৷ দিল্লির একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ সেই চিকিৎসার টাকা সরকার দেয়৷ মন্ত্রী থাকা অবস্থায় প্রিয়রঞ্জন অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ তারপর থেকে তিনি হাসাপাতালে আছেন৷ তার জন্য খরচের অঙ্কটাও কম নয়৷
মনমোহন সিংয়ের পর নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন৷ কংগ্রেসের সঙ্গে তার সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়৷ কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের স্লোগান দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন৷ ভোটের সময় সোনিয়া, রাহুল সহ কংগ্রেস নেতাদের রঙ্গব্যাঙ্গের কষাঘাতে সমানে ক্ষতবিক্ষত করেছেন৷ তাই তিনি সরকারি টাকায় বেসরকারি হাসপাতালে কংগ্রেসের এক নেতার চিকিৎসা চালাবার খরচ যোগাবেন কি না তানিয়ে কংগ্রেস নেতাদের ষোলআনা সংশয় ছিল৷
কিন্তু সেই সংশয়কে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মোদী৷ আমৃত্যু প্রিয়রঞ্জন সেই বেসরকারি হাসপাতালেই ছিলেন৷ তার পরবর্তীকালে বিরোধী নেতারা যার বিরুদ্ধে বারবার করে প্রথাভাঙার অভিযোগ তুলেছিলেন, সেই মোদী কিন্তু প্রিয়রঞ্জনের চিকিৎসা নিয়ে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রথা ভাঙেননি৷
একই কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও সত্যি৷ আরএসপি-র সাবেক সাংসদ অবনী রায় তখন খুবই অসুস্থ৷ তারও চিকিৎসা করতে প্রচুর খরচ হয়েছে৷ তার উপর ওষুধের খরচও প্রচুর৷ সাংসদরা যে প্রচুর পেনশন পান এমন নয়৷ পেনশনের অর্থে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না অবনী রায়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেকথা জানতে পেরে তাকে এক লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন৷ বাম নেতার প্রতি এই সৌজন্য দেখাতে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি৷
সোনিয়া গান্ধীও মাঝেমধ্যে স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য বিদেশে যান৷ বিজেপি রাহুলের বিদেশযাত্রা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানান মন্তব্য করেছে এবং এখনও সুযোগ পেলেই করে৷ কিন্তু সোনিয়ার বিদেশে গিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা নিয়ে তারা কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি৷ ভারতে ক্রমশ শিষ্টাচারহীন রাজনীতির আসরে অন্তত এই সৌজন্যটুকু এখনো বজায় আছে৷
ভারতে প্রধানমন্ত্রীর একটা তহবিল আছে৷ সেই তহবিল থেকে গরিব মানুষকে চিকিৎসার জন্য অর্থসাহায্য করা হয়৷ অটলবিহার বাজপেয়ী, মনমোহন সিংয়ের সময় দেখেছি, নরেন্দ্র মোদীর সময়ও দেখছি, সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে গরিবরা এই তহবিল থেকে সাহায্য পান৷ বিরোধী নেতা, সাংসদরা সুপারিশ করলে সেটাও রাখার চেষ্টা হয়৷
তাই বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ভারত রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে একেবারে আদর্শ জায়গায় আছে৷ গত ১৪ নভেম্বরের ঘটনা৷ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মদিবস৷ সংসদের সেন্ট্রাল হলে নেহরুর ছবিতে মালা দেয়া হয় ওইদিন৷ সব নেতার জন্মদিনেই হয়৷ কিন্তু এই বছর সেখানে সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন মাত্র একজন জুনিয়ার মন্ত্রী ৷ সোনিয়া গান্ধী, রাজ্যসভার বিরোধী নেতা ও প্রবীণ কংগ্রেসি মল্লিকার্জুন খাড়গেরা সেই অনুষ্ঠানে ছলেন৷ এরপর কংগ্রেস নেতারা মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ নেহরুর জন্মদিনে কি অন্তত একজন পূর্ণমন্ত্রীর উপস্থিত থাকা উচিত ছিল না?
সংসদের গত অধিবেশনে স্পিকার ওম বিড়লা একটা বৈঠক ডেকেছিলেন৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধী দুজনেই ছিলেন৷ কিন্তু তারা একটা কথাও বলেননি৷ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যে কি অন্তত দু-চারটি বাক্য বিনিময় করার মতো সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয় নয়?
ভোটের ময়দানে নেতা ও নেত্রীরা একে অপরের বিরুদ্ধে যে ধরনের বিশেষণ ব্যবহার করেন, সেটাও তো অনেক সময় শিষ্টাচার বহির্ভূত৷ তাই শরীর খারাপ হলে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখনো রজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় আছে ঠিকই, কিন্তু এটাও বা আর কতদিন থাকবে, সেটাই প্রশ্ন৷
অটলবিহারী বাজপেয়ীকে কোনো প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি এসপিজি কম্যান্ডোদের থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন শুনতেন, কখনো জবাব দিতেন, কখনো হেসে এড়িয়ে যেতেন৷ মনমোহন সিং-এর মতো মিতভাষী প্রধানমন্ত্রী বছরে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতেন৷ বিদেশে বিমানে যাওয়ার বা ফেরার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতেন৷ সংসদে প্রশ্নের উত্তর দিতেন৷ গত সাড়ে সাত বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদী সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে একটা প্রশ্নেরও জবাব দেননি৷ একবারের জন্য সাংবাদিক সম্মলেন করেননি৷ সুতরাং পরিবর্তন তো হচ্ছে, হয়ও৷
তাই মনে হয়, এই পরিবর্তনের সময়ে অন্তত এই রাজনৈতিক শিষ্টাচারটুকু বজায় থাকুক৷ এর পরিবর্তন হওয়াটা কাম্য নয়৷