এই প্রভাতে নেই তুমি
১৬ অক্টোবর ২০২১অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক, শিক্ষক ড. ইনামুল হক ৭৮ বছর বয়সে অনন্তকালের পথে যাত্রা করেছেন৷ তিনি সুস্থই ছিলেন৷ কোনো ধরনের অসুস্থতা দেখা যায়নি৷ ঢাকার বেইলি রোডের বাসায় ছিলেন৷ ১১ অক্টোবর ঘরের চেয়ারে বসা অবস্থায় নিভে গেছে জীবনপ্রদীপ৷ স্ত্রী অভিনেত্রী লাকী ইনাম, দুই মেয়ে অভিনেত্রী হৃদি হক ও প্রৈতি হক, দুই জামাতা অভিনেতা লিটু আনাম ও সাজু খাদেম৷ পুরো পরিবারই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷
ড. ইনামুল হককে আর হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে না৷ তার চিরবিদায়ে পরিবারে এখন শোকের আবহ৷ লাকী ইনামের স্মৃতির জলে ভাসছে এই প্রিয়মুখ৷ গুণী অভিনেত্রী ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা শুধু জীবনসঙ্গী ছিলাম না, আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম৷ আমি কিছু জানলে তাকে জানানোর জন্য অস্থির হয়ে যেতাম৷ তিনিও ঠিক একইরকম ছিলেন, আমাকে কিছু না বলে শান্তি পেতেন না৷ আমাদের বন্ধুত্ব এবং ৫০ বছরের পথচলাটা ছিল অতুলনীয়৷ এর সঙ্গে অন্যকিছুর তুলনা হয় না৷ সংসার, সংস্কৃতি ও সামাজিক চর্চা— সবকিছু একসঙ্গে করেছি আমরা৷ ও কিছু না পারলে আমি বলতাম, আমি কিছু না পারলে ও বলতো৷ অথচ আমাকে ছেড়ে এত নীরবে চলে গেল! আমাকে কিছু বলে গেল না৷ ওর কষ্ট হচ্ছিল কিনা তা-ও আমি জানি না৷ একটা অদ্ভুত উত্থান!’’
ড. ইনামুল হক করোনাকালে চলে গেলেও শরীরে বাসা বাঁধেনি এই জীবাণু৷ খুব সাবধানে থাকতেন৷ লাকী ইনামের কথায়, ‘তার করোনা ছিল না৷ করোনাকালে অস্কার ওয়াইল্ড, হ্যারল্ড পিন্টারসহ বিখ্যাত নাট্যকারদের ১৭টি নাটক অনুবাদ করেছেন তিনি৷ চারদিন আগেও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রকাশের জন্য উৎসাহের সঙ্গে এগুলো পাঠাতে বলেন তাকে৷ করোনার পুরোটা সময় তিনি নাটক অনুবাদের পাশাপাশি লেখাপড়া করেছেন৷ এভাবেই তার দিন কেটেছে৷ তিনি সাবধানে থাকতেন৷ বাইরে যেতেন না৷ শুটিংও করেননি৷ খুব সৃজনশীল একটা সময় কেটেছে তার৷ হয়ত চলে যাবেন বলেই ভালো ভালো কাজ করেছেন৷’’
২০২০ ও চলতি বছর মঞ্চের কয়েকজন নাট্যজনের জীবনাবসান হয়েছে করোনায়৷ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী (৮৬), নৃত্যপরিচালক হাসান ইমাম (৬৭) এবং ‘নাট্যজন’-এর সভাপতি তবিবুল ইসলাম বাবু (৭৭)৷
সিনেমার হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র
দেশীয় চলচ্চিত্রের এক বিরল নক্ষত্র ছিলেন সারাহ বেগম কবরী (৭০)৷ দর্শক মন জয় করা ঢাকাই সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’কে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল কেড়ে নিয়েছে করোনা৷ একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও আজীবন সম্মাননা পাওয়া ‘সারেং বৌ’র মুন্সিয়ানা ছিল নির্মাণেও৷ ‘আয়না’র (২০০৫) পর শুরু করেছিলেন নিজের পরিচালনায় দ্বিতীয় ছবি ‘এই তুমি সেই তুমি’-র কাজ৷ এর মধ্য দিয়ে পরিচালনায় দীর্ঘ ১৪ বছরের বিরতি ভাঙেন তিনি৷
করোনার থাবায় বিনোদন অঙ্গনের অনেক কাজ থমকে আছে৷ এর দৃষ্টান্ত কবরী পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’৷ ছবিটি এখনো অসমাপ্ত৷ ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৮’র প্রথম রানারআপ নিশাত নাওয়ার সালওয়া অভিনীত ‘এই তুমি এই তুমি’র সবশেষ খবর কী? কবরীর ছেলে শাকের ওসমান চিশতি বলেন, ‘‘আম্মু শুটিং শেষ করে যেতে পারেননি৷ এখন মহামারির কারণে আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে৷ করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়৷ কিন্তু একটি শুটিং ইউনিটে ৩০-৪০ জন থাকে৷ আমি তো তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলতে পারি না৷ তাই আরো একটু অপেক্ষা করতে চাই৷ আরেকটি ব্যাপার হলো, সরকারি অনুদানের পুরো অর্থ এখনো আমরা পাইনি৷ এক্ষেত্রে কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি আছে, এ কারণে একটু বিলম্ব হচ্ছে৷ আর যেটুকু কাজ হয়েছে তা নিয়ে আমরা পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি৷ বেশি জনবল যেখানে প্রয়োজন পড়ে না সেগুলো আমরা করে যাচ্ছি৷ সম্পাদনা, কালার কারেকশন, কালার গ্রেডিং ও সাউন্ডের কাজ চলছে৷ কিন্তু শুটিং না করলে তো আর ছবিটা শেষ হবে না৷ তাই আমরা মহামারি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি৷ সবাই যখন নিরাপদ বোধ করবে, তখন বাকি শুটিং শেষ করে ফেলবো৷’’
ঢাকার গুলশান ২ নম্বরে কবরীর ফ্ল্যাটে থাকছেন শাকের ওসমান চিশতি৷ কিন্তু তার দাবি, ফ্ল্যাটটি দখলের চক্রান্ত চলছে৷ গত ২৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সিসি ক্যামেরায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের সব বাতি নেভানো, মোবাইল ফোনের আলোতে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ এবং ইন্টারকমে ফোন দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন তিনি৷ খবর পেয়ে গুলশান থানা পুলিশের কয়েকটি টিম বাড়িটি ঘেরাও করে৷ যদিও পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অস্বাভাবিক কিছুই পায়নি৷ ঘটনার পরদিন গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শাকের ওসমান চিশতি৷ পুলিশ এখন এর তদন্ত করছে৷
পাঁচতলা বাড়িটির জায়গা-জমি কবরীর নিজের৷ একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ভবনটি গড়ে তোলেন তিনি৷ বিভিন্ন ব্যক্তি ওই প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট কিনেছে৷ কবরীও একটি ফ্ল্যাট রেখে বাকিগুলো বিক্রি করেছেন৷ বর্তমানে পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন শাকের ওসমান চিশতি৷ কবরীর অন্য চার সন্তান প্রবাসী৷ তারা দেশে এলে এই ফ্ল্যাটে ওঠেন৷
শাকের ওসমান চিশতি বলেন, ‘‘আম্মু থাকাকালীন তিনি আমাদের ওপর ছাতা হয়ে ছিলেন৷ তিনি নিজের সব ছেলেকে সুরক্ষায় রাখতেন৷ এখন আমার পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা খুব কঠিন৷ এখানে বসবাস করার উপায় নেই৷ আমি এ নিয়ে খুব চিন্তিত ও হতাশ৷ প্রশাসনকে বললেও কেউ কিছু করছে না৷ তারা বলছে শুধু, দেখবো-দেখবো৷ আম্মু বেঁচে থাকা অবস্থায় এই বাড়ি নিয়ে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করেছিল৷ আম্মুকে তখন লাঞ্ছিত করা হয়, হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়৷ এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল তিনি গুলশান থানায় জিডি করেছিলেন৷ আম্মু এই পরিস্থিতি চার বছর ধরে দেখেছে৷ আর আমি এক মাসের মতো হলো দেখছি৷ এরকম যদি হতে থাকে তাহলে তো আমি ইংল্যান্ডে ফেরত চলে যাবো৷ এসবের কারণে সিনেমার কাজেও মনোযোগ দিতে পারছি না৷ কারণ, আমাকে আইনজীবীর পেছনে দৌড়াতে হচ্ছে৷’’
‘বধূ বিদায়’সহ কবরীর বেশকিছু সিনেমার সহশিল্পী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী খ্যাতিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান (৭৯) বার্ধক্যজনিত রোগে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি মারা যান৷ তার তিন মেয়ে কস্তুরি আহমেদ, কেতুকী আহমেদ ও কোয়েল আহমেদ৷ বড় ছেলে এটিএম কামালুজ্জামান কবির বেঁচে নেই৷ ছোট ছেলের নাম এটিএম খলিকুজ্জামান কুশল৷
এটিএম শামসুজ্জামানের স্ত্রী রুনী জামান ডয়েচে ভেলের সামনে স্মৃতির জানালা মেলে ধরেন, ‘‘৫৩ বছরের সংসার জীবন ছিল আমাদের৷ সেই মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে৷ কী খাবেন, কতটুকু খাবেন— বলতে গেলে সবকিছুর জন্য আমার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন৷ সাড়ে চার মাস হাসপাতালে ছিলেন তিনি, আমি বলতে পারবো না তাকে ছাড়া একটি মুহূর্ত কোথাও থেকেছি৷ তিনি এমন একজন, যার প্রতিটি কথা এবং তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে অমূল্য৷ কোনো নাটক করার আগে স্ক্রিপ্ট আমাকে শুনিয়ে জানতে চাইতেন, বলো তো কেমন হবে?’’
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে স্বামীর রেখে যাওয়া বাসায় থাকেন রুনী জামান৷ কীভাবে চলছে তার দিন? এটিএম শামসুজ্জামানের স্ত্রীর উত্তর, ‘‘আমাদের সঞ্চয় যা ছিল তা দিয়েই চলছে৷ সন্তানদের যাকে যা দেওয়ার তাকে তা দিয়েছি৷ কারণ, আমি কখন মারা যাই তা তো আর বলা যায় না৷ তাই আমি আর আমার স্বামী দাবির নীচে থাকতে চাইনি৷ আমি এখন যে বাড়িতে আছি, যখন আমি থাকবো না, তখন আমার সন্তানরাই এটি পাবে৷’’
চলচ্চিত্রাঙ্গনে এটিএম শামসুজ্জামানের সহকর্মী কিংবা নতুন প্রজন্মের কেউই তার পরিবারের খোঁজ নেয় না৷ এ কথা জানানোর সঙ্গে রুনী জামান যোগ করেন, ‘‘এটাই সবচেয়ে বড় কষ্টের৷’’
একই রকম হতাশা ঢাকাই ছবির প্রতাপশালী অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর স্ত্রী শাহনাজ জাহানের, ‘‘তার প্রথম মৃত্যুবাার্ষিকী গেল, কিন্তু জাতীয় দৈনিক বা রেডিওতে তো তার কোনো খবর আসেনি৷ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তার কি কোনো অবদান ছিল না? তিনি মঞ্চ, টিভি, রেডিও থেকে তারপর সিনেমায় গেছেন৷ ৩০০-৪০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন৷ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তো অন্তত স্মরণ করা যেতো তাকে৷ তাতেই তো আমরা খুশি থাকতাম৷ শিল্পীরা বেঁচে থাকে তাদের কর্মে৷ জন্মবার্ষিকী-মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করলে আমরা গর্বিত হই৷ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এমন একজন শিল্পীকে নিয়ে দুটি কথা লেখা হলো না, এটা দুঃখজনক না? আমাদের দাবি, গুণীদের স্মরণ করুন৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে যেন তারা বেঁচে থাকেন৷ তা না হলে তারা একসময় হারিয়ে যায়৷ কিন্তু এটুকুই আমাদের দেশে পাওয়া যায় না৷’’
সাদেক বাচ্চু ছিলেন অভিনয় পাগল৷ গত বছর করোনা কিছুটা কমার পর শুটিংয়ে ফেরেন৷ শাহনাজ জাহান বললেন, ‘‘অভিনয়ের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল৷ একটি রিসোর্টে নাটকের শুটিং করে ফেরার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই তার জ্বর আসে৷ এর ১২ দিনের মাথায় মারা গেলেন৷ আমরা তার শিল্প-ক্ষুধা আটকে রাখতে পারিনি৷ তিনি দেড় বছর বসে ছিলেন করোনার কারণে৷ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর আগে শুটিং করে গেছেন৷’’
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর করোনায় হারিয়ে গেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা সাদেক বাচ্চু৷ তার চলে যাওয়ার একবছর পেরিয়েছে৷ দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে এখন দিন কাটে শাহনাজ জাহানের৷ বড় মেয়ে সাদিকা ফায়রুজ মেহজাবিন এইচএসসি পরীক্ষার্থী; আরেক মেয়ে মালিহা দারিনী নওশিন এসএসসি দেবে এবার৷ আর ছেলে সাদেক সোয়ালেহিন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে৷
সাদেক বাচ্চুর স্ত্রীর কথায়, ‘‘মানুষটার অভাব তো আর কখনো পূরণ হবে না৷ বাচ্চারা বাবা হারিয়েছে, আমি স্বামী হারিয়েছি৷ এটি অপূরণীয় একটি অভাব৷ তারপরও ধৈর্য ধরে থাকছি৷ সব ভোলার চেষ্টা করছি৷ তবে আমরা ভালো আছি৷ তাকে ছাড়াই ভালো থাকতে হচ্ছে৷ আমার শ্বশুর ডাকবিভাগে ছিলেন৷ সেই সুবাদে আমার স্বামী ডাকবিভাগে চাকরি পান৷ অবসরে গিয়েছিলেন, তাই পেনশনের টাকা পাচ্ছি৷ আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে৷ আল্লাহ আমাদের চালিয়ে নিচ্ছেন৷’’
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী বাবার মতো সন্তানদের কারো অভিনয়ের আসার ইচ্ছে নেই৷ তাছাড়া সাদেক বাচ্চুর স্ত্রী শাহনাজ জাহানও সেটা চান না, ‘‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পীদের সম্মান আছে? সারাজীবন তাদের বাবা অভিনয়ে ছিলেন৷ আমার স্বামী সিনেমা থেকে আয় করেছেন৷ তবে অভিনয়কে কখনো পেশা হিসেবে নেননি৷ অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে অভিনয় করেছেন৷ কিন্তু আমাদের দেশে শিল্পীদের স্মরণ করা হয় না, এটা দুঃখজনক৷ তাদের মূল্যায়ন নেই৷ এ কারণে আমার সন্তানরা অভিনয়ে আসুক তা চাই না৷ ওরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে, সেটাই ভালো৷’’
এরপর শাহনাজ জাহানের কণ্ঠে কিছুটা তৃপ্তির সুর, ‘‘সালমান শাহ ও সাদেক বাচ্চুর মতো সেপ্টেম্বরে যারা মারা গেছেন, তাদের স্মরণে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছিল৷ ফেসবুকে আমাকে ছবি পাঠিয়ে এটা জানিয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান৷ এছাড়া টিভিতে তার সিনেমা দেখে মানুষ আমাকে ফোন করে৷ ভালো লাগে ভেবে যে, মানুষ মনে রেখেছে৷’’
করোনাকালে মারা যাওয়া চলচ্চিত্র শিল্পী-কুশলীদের তথ্য ডয়েচে ভেলেকে দিয়েছেন শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান৷ ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী শিল্প নির্দেশক মহিউদ্দীন ফারুক (৭৯), ১ জুন প্রযোজক মোজাম্মেল হক সরকার (৫৬), ৬ জুন নৃত্য পরিচালক এস আলম, ২৮ জুলাই পরিচালক আফতাব খান টুলু (৬৬), ২৩ অক্টোবর প্রযোজক-পরিচালক শরীফউদ্দীন খান দীপু (৬৫), ৩ নভেম্বর প্রযোজক নাসির উদ্দিন দিলু (৭৬) এবং ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মিন্টু (৮১) করোনায় মারা যান৷
থেমে গেছে সুর
করোনাভাইরাসে স্তব্ধ হয়েছে অনেকের কণ্ঠ৷ থেমে গেছে সুর৷ কয়েকজন গুণী শিল্পী চলে গেছেন চিরঘুমে৷ করোনাক্রান্ত হয়ে গত ২৩ জুলাই চিরতরে নীরব হয়ে যান গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর (৭১)৷ একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর নামে রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার ৬ নম্বর সড়কের নামকরণ হচ্ছে৷ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এই ঘোষণা দিয়েছে৷ ফলে তার পরিবারের মধ্যে আনন্দের আবহ এসেছে৷
ফকির আলমগীরের স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর ডয়েচে ভেলের কাছে সেই আনন্দ প্রকাশ করেন, ‘‘তার নামে সড়কের নামকরণ হওয়ায় আমরা অনেক খুশি৷ যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এই সড়ক থাকবে৷ এটা আমাদের জন্য অনেক খুশির একটি সংবাদ৷’’
১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি সুরাইয়া আলমগীকে বিয়ে করেন ফকির আলমগীর৷ স্বামীকে ছাড়া কেমন আছেন? সুরাইয়া আলমগীর বলেন, ‘‘আর কেমন থাকি! আমাদের আনন্দের রঙপেন্সিল, যা দিয়ে আমরা নতুন নতুন শব্দ বাঁধতাম, সেগুলো তো হারিয়ে গেছে৷ জীবনের এত বছর তার সঙ্গে কাটিয়েছি৷ কত সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি! আমি পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই তার সফরসঙ্গী ছিলাম৷ তার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি৷’’
গণমানুষের শিল্পী ছিলেন ফকির আলমগীর৷ গানে গানে বাংলার নিপীড়িত, বঞ্চিত ও মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন৷ গণসংগীতের মশাল তুলে ধরেছেন একাই৷ কিন্তু করোনার কাছে হেরে গেছেন৷ তার তিন ছেলে ফকির আশিক আলমগীর রানা, ফকির মাশুক আলমগীর রাজিব এবং ফকির হাসান আলমগীর রাহুল৷ মেজ ও ছোট ছেলে গান করে৷ গানের পাশাপাশি মাশুক ভালো গিটার বাজাতে পারেন৷
ছেলেদের তেমন আয় নেই৷ তাহলে এখন চলছেন কীভাবে? সুরাইয়া আলমগীর দীর্ঘশ্বাস টেনে বলতে থাকলেন, ‘‘আমার আয়ের উৎস তো বন্ধ হয়ে গেছে৷ তিনি থাকলে গান করে বিভিন্ন জায়গা থেকে আয় করে এনে দিতেন৷ সেই সুযোগ এখন নেই৷ আর বসে বসে খেলে তো রাজার ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়৷ আপাতত বাসা ভাড়া দিয়ে চলছি৷ অর্থকষ্ট তেমন নেই৷ চলে যাচ্ছে মোটামুটি৷ কিন্তু আমি তো অসহায়৷ বর্তমানে যে বাড়িটিতে অবস্থান করছি তা আমার না, তিন ছেলের নামে৷ আমার তিন নাতি-নাতনির সঙ্গে আছি৷ ফকির আলমগীর বুঝতে পারেননি হঠাৎ তার মৃত্যু হবে৷ তিনি ভেবেছিলেন আরো কিছুদিন বাঁচবেন৷ তাই কিছু বলে যেতে পারেননি৷ তাকে আমরা হাসপাতালে নিলাম ঠিকই৷ কিন্তু সেখান থেকে আর জীবিত বের করতে পারলাম না৷ একদিনের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল৷’’
সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফকির আলমগীর৷ তার স্ত্রী জানালেন, এখন এটি সংগঠনের নীতিমালা অনুযায়ী চলছে৷ তাকে সভাপতি করে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ আগামী ২৭ নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন ফকির আলমগীর স্মরণে বড় আকারে করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের৷ এ উপলক্ষে প্রয়ানত শিল্পীকে নিয়ে ভারতবর্ষের জ্ঞানী-গুণীদের মন্তব্যের সংকলন প্রকাশ হতে পারে৷ সুরাইয়া আলমগীরের প্রতিশ্রুতি, ‘‘তার যত ইচ্ছে আছে সব পূরণ করবো৷ আগামী বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তার জন্মদিন পালন করা হবে৷ এটা তার ইচ্ছে ছিল৷’’
করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল মারা গেছেন রবীন্দ্রসংগীতের বরেণ্য শিল্পী মিতা হক (৫৯)৷ তিনি ছিলেন অভিনেতা খালেদ খানের স্ত্রী৷ তার চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক৷ মেয়ে জয়ীতা রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী৷ জামাতা অভিনেতা মুস্তাফিজ শাহিন৷ সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক পান মিতা হক৷
মা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চান জয়িতা৷ ডয়েচে ভেলের কাছে নিজের অনুভূতির কথা জানালেন এভাবে, ‘‘আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি সবাইকেই হারিয়েছি৷ মায়ের চলে যাওয়াটা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না৷ বেঁচে থাকার জন্য কিছু প্রক্রিয়া রপ্ত করতে হয় কখনো কখনো৷ যেমন আমি খুব গভীরে গিয়ে চিন্তা করাটাই বন্ধ করে দিয়েছি৷ পালিয়ে বেড়ানো বলতে পারেন! পালিয়ে না বেড়ালে মনে হয় আমি আর নিঃশ্বাসই নিতে পারবো না৷ মা চলে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করছি নিজেকে সময় দেওয়ার, নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার৷ মা এটাই মনেপ্রাণে চাইতেন, যা আমি কখনোই ছিলাম না৷ আমার গানের ব্যাপারে নিজের উদ্যোগ না থাকা নিয়ে দুঃখ ছিল মায়ের৷ তখন উড়িয়ে দিতাম এসব অনুযোগ৷ এখন এগুলো নিয়ে মনোযোগী হচ্ছি ধীরে ধীরে৷ মনে হয়, মা যদি দেখতে পেয়ে থাকেন. তাহলে হয়তো স্বস্তি পাচ্ছেন৷ আর হ্যাঁ— মায়ের দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও এগুলো নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করতো৷ গর্বিত করতো৷ আমিও এই চেতনাই বহন করি৷ আমিও তার মতো স্পষ্ট করে কথা বলতে চাই, যখন যেখানে প্রয়োজন৷ মায়ের অনুপস্থিতি আমাকে শিল্পী হিসেবে, মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে আরো সচেতন হতে দায়বদ্ধ করেছে৷ আমি তার মতো সাহসী মানুষ হতে চাই৷ এটাই আমার চাওয়া নিজের কাছে৷’’
নন্দিত সংগীতশিল্পীদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বরেণ্য নজরুল সংগীতশিল্পী জোসেফ কমল রড্রিক্স (৬৮) আর ২ মার্চ না ফেরার দেশে চলে যান ‘একটি গন্ধমেরও লাগিয়া’ গানের শিল্পী ও দোয়েল প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী জানে আলম৷ ৭ এপ্রিল একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকগানের শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী (৭৫), ১৩ এপ্রিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ (৬০), ৪ জুলাই ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের গীতিকবি ফজল-এ-খোদা (৮০), ১৮ জুলাই তরুণ সংগীতশিল্পী বর্ণ চক্রবর্তী (৩৫) চলে যান পরপারে৷ এর আগে গত বছরের ১৪ এপ্রিল একসময়ের পল্লীগীতির জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নিউইয়র্ক প্রবাসী বীনা মজুমদার, ১০ ডিসেম্বর অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতার স্বত্বাধিকারী সেলিম খান (৫৫) মারা যান৷
ছোট পর্দায় করোনার থাবা এবং হানিফ সংকেতের ভাবনা
করোনা কেড়ে নিয়েছে একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, নির্দেশক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আলী যাকেরকে (৭৬)৷ গত বছরের ২৭ নভেম্বর চিরবিদায় নেন তিনি৷ মঞ্চ ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন সবার প্রিয় ‘ছোটলু’৷ ‘আজ রবিবার’ নাটকের বড় চাচা কিংবা ‘বহুব্রীহি’র মামা চরিত্র তাকে বাঁচিয়ে রাখবে দর্শক হৃদয়ে৷
আলী যাকেরের ছেলে, অভিনেতা ইরেশ যাকের বলেন, ‘‘আমি এখনো প্রতিদিন বাবার ঘরে যাই৷ বাবা যে বিছানায় শুয়ে থাকতেন সেখান থেকে এখন বাবার কবরটি দেখা যায়৷ বাবার কবর আমাদের বাসার ঠিক পাশেই৷ তো এগুলো নিয়েই এখন থাকতে হবে৷ বেদনা নিয়েই থাকতে হবে৷ এটি কাটিয়ে ওঠার কোনো উপায় আছে কিনা আমার জানা নেই৷ এই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে আমাকে যেতেই হবে৷ আর এটি আমি ধরেই নিয়েছি৷ বাবা চলে যাওয়ার পর তার অনেক কাজ ও তার জীবন নিয়ে অনেক ভাবনা শুরু করেছি৷ তিনি কীভাবে বাঁচতেন বা কীভাবে বাঁচতে চাইতেন, কেমন জগৎ দেখতে চাইতেন, সেগুলো বিভিন্নভাবে আমার লেখা ও আমার ছবি তোলায় এখন ধরে রাখার চেষ্টা করি৷’’
ছোট পর্দার আরেক শক্তিমান অভিনেতা আবদুল কাদের (৬৯) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন৷ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে ‘মামা’ চরিত্রে প্রায় ২৫ বছর ধরে অভিনয় করেছেন তিনি৷ তার মতোই করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর মারা যান গুণী অভিনেতা কে এস ফিরোজ (৭৬)৷ এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন অভিনেতা মহিউদ্দিন বাহার৷ তারাও ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত মুখ ছিলেন৷
ডয়েচে ভেলের উল্লেখ করা এই তিন শিল্পীর সঙ্গে ‘ইত্যাদি’র স্রষ্টা হানিফ সংকেত যোগ করলেন, “সাইফুদ্দিন আহমেদের কথা ধরেন, তিনি যখন একলাইন অভিনয় করতে পারতেন, তখনও তাকে নিয়েছি৷ যখন দেখলাম পারে নাই, একশব্দ বলতে পেরেছে, তখনও তার কাছে গিয়েছি৷ ওনার কিন্তু জীবনের শেষ অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’৷ খালিদ হাসান মিলু, আজম খান এবং এন্ড্রু কিশোরের জীবনের শেষ গান ‘ইত্যাদি’তে৷ অভিনেতা হিসেবে নাজমুল হুদা বাচ্চু, কে এস ফিরোজের শেষ অভিনয় ‘ইত্যাদি’তে৷ তারা আমার অনুষ্ঠানের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন৷ এই যে একজন-একজন করে চলে যাচ্ছে, আমার ‘ইত্যাদি’ শূন্য হচ্ছে৷ আমি যখন স্ক্রিপ্ট লিখি, ভাবি— কাকে দিয়ে অভিনয় করাবো? শিল্পী তো নাই! কাকে দেবো? কী করবো? আমি শূন্যতায় ভুগি৷ তখনই স্মৃতিতে হারিয়ে যাই যে, হায় এই শিল্পীগুলো তো আমার সঙ্গে ছিল! এখন নাই৷ একদিন আমিও তো চলে যাবো৷ কাজটা তো বড় বিষয় না৷ এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক ছিল, এই মানুষগুলো ‘ইত্যাদি’কে ভালোবাসতো, আমাকে ভালোবাসতো৷ মহিউদ্দিন বাহার অভিনয় ছেড়ে দিলেন৷ তারপরও তিনি অ্যাম্বুলেন্সে করে আসতেন৷ আমি তাকে চেয়ারে করে ওপরে তুলতাম৷ তারপরও তিনি শেষ অভিনয় করে গেছেন৷ কারণ, তিনি আমাকে বলেছিলেন, হানিফ ভাই, আমি করতে চাই৷ কারণ, এখানে একটি পরিবারের মতো কাজ হয়৷ সবার ভালোবাসা পাই৷ এগুলো তো আমার অনুভূতি৷ আমার কষ্ট আমার মাঝেই থাকুক৷’’
করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৩১ মে টিভি ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ (৭৮), ৩ আগস্ট বিটিভির সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের প্রযোজক মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ, ২২ সেপ্টেম্বর অভিনেত্রী মিনু মমতাজ, এ বছরের ১৮ এপ্রিল একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ অভিনেতা ও নাট্যশিক্ষক এস এম মহসীন (৭৩); ১০ জুলাই বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘পথে প্রান্তরে’র নির্মাতা, নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা স্বপন সিদ্দিকীও চলে গেছেন শিল্প-সংস্কৃতির জগতে শূন্যতা বাড়িয়ে৷