1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঋণ খেলাপি না হলে কীসের শিল্পপতি?

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ
২ ডিসেম্বর ২০২২

ভারতে শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের নামের তালিকা পর্যন্ত প্রকাশ করতে চায় না সরকার৷ উধাও হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ কোটি টাকা৷

https://p.dw.com/p/4KO9o
পশ্চিমবঙ্গে এক ব্যক্তি ভারতীয় মুদ্রা গুনছেন
ভারতীয় মুদ্রাছবি: Soumyabrata Roy/NurPhoto/IMAGO

এক লাখ ৮৪ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা৷ না, অংকটা ভারতের কোনো নতুন প্রকল্পের বাজেট নয়৷ দেশের প্রথম সারির ঋণখেলাপিদের মোট ঋণ খেলাপের সংখ্যা৷ গত ১০ বছরে যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে৷

সম্প্রতি বাংলাদেশে দুইটি কোম্পানির সঙ্গে ব্যাংকের লেনদেন নিয়ে বিপুল আলোড়ন শুরু হয়েছে৷ ভারতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না বিরাট বাণিজ্য সাম্রাজ্য তৈরির গল্প নতুন নয়৷ বিজয় মালিয়া, মেহুল চোকসি, নীরব মোদীরা কেবলমাত্র হিমবাহের হিমশৈল মাত্র৷ গোটা দেশে কোটি কোটিপতি ঋণখেলাপির সংখ্যা কয়েকহাজার৷ যার মধ্যে আছেন তাবড় তাবড় শিল্পপতি, উদ্যোগপতিরা৷ সরকার বরাবরই তাদের আড়াল করার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ৷ সংসদে এই ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের দাবি বহুদিনের৷ কিন্তু কখনোই সেই তালিকা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা হয় না৷ চোর পালালে তাদের নিয়ে সাময়িক শোরগোল হয় মাত্র৷ বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী, মেহুল চোকসি তেমনই কয়েকটি নাম৷

মানিলাইফ ডট ইন দীর্ঘদিন ধরে এই ঋণখেলাপিদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করছে৷ গত অগাস্ট মাসে তাদের একটি রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছে, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা দুই হাজার ২৩৭জন৷ মোট ঋণ খেলাপের পরিমাণ এক লাখ ৮৪ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা৷ কোথা থেকে পাওয়া গেল এই তথ্য?

পুণের সমাজকর্মী বিবেক ভেলাঙ্কার তথ্য জানা অধিকার আইনে একটি প্রশ্ন নথিভুক্ত করেছিলেন৷ তারই জবাবে সরকার যে তথ্য দিয়েছে, তা থেকে এই ভয়াবহ বিষয়টি সামনে এসেছে৷ বিবেকের দাবি, এই মোট ঋণ খেলাপের অংকের ৭৬ শতাংশ রয়েছে মাত্র ৩১২জন বিগ শট শিল্পপতির হাতে৷ তাদের মোট ঋণ খেলাপের পরিমাণ এক লাখ ৪১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা৷

মেহুল চোকসি, নীরব মোদী, বিজয় মালিয়ারা এর মধ্যে আছেন৷ কিন্তু তারা বাদ দিয়েও সেই তালিকায় এমন সব ব্যক্তির সংস্থার নাম আছে, যা শুনলে চোখ ছানাবড়া হতে বাধ্য৷ বস্তুত, মানিলাইফ এমন সব সংস্থার একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে৷ সংস্থাগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এর মধ্যে একধিক শেল কোম্পানিও আছে৷ অবৈধ ওই কোম্পানিগুলির আড়ালে বিপুল পরিমাণ ঋণের লেনদেন হয়েছে৷

বস্তুত, সম্প্রতি এনডিটিভি হস্তান্তরের সময়েও এমন একটি ‘শেল কোম্পানি’র নাম উঠে এসেছে৷ কীভাবে সেই কোম্পানি তৈরি হয়েছে এবং পরবর্তীকালে বিক্রি হয়েছে, তা নিয়েও কোনো কোনো মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷

সমস্যা হলো, ভারতে এখনো পর্যন্ত ঋণ খেলাপের আসল পরিমাণ এবং সমস্ত ঋণখেলাপির নাম জানা যায় না৷ কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস চালিত ইউপিএ সরকার ছিল, তখন বিরোধী বিজেপি শিবির বার বার ঋণ খেলাপিদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছে৷ সরকার বদলেছে৷ এখন কেন্দ্রে বিজেপি পরিচালিত এনডিএ সরকার৷ কিন্তু বর্তমান সরকারও ঋণ খেলাপির সার্বিক তালিকা প্রকাশ করে উঠতে পারেনি৷ নিন্দুকেরা বলেন, আসলে কোনো সরকারই এই তালিকা প্রকাশ করতে চান না৷ প্রকাশ করলে কান টানতে মাথা চলে আসবে৷

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে এক প্রবীণ সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন তার অভিজ্ঞতার কথা৷ তখন কংগ্রেস আমল৷ তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি৷ অর্থমন্ত্রীর অফিসে তিনি বসে আছেন, এমন সময় এক বিখ্যাত উদ্যোগপতির ফোন আসে তার কাছে৷ খানিকক্ষণ কথা বলার পর, সাংবাদিকের সামনে বসেই অর্থমন্ত্রীর অফিস থেকে ফোন যায় একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে৷ নির্দেশ যায়, ওই উদ্যোগপতিকে যেন ঋণ দেওয়া হয়৷ স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর অফিসের নির্দেশ পাওয়ার পর কোনো ব্যাংকের মুরদ নেই, ঋণ দিতে অস্বীকার করার৷ বর্তমান খেলাপিদের তালিকায় এখন ওই উদ্যোগপতির নামও আছে৷ এবং বিজেপি আমলেও বহাল তবিয়তে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷

খেয়াল করলে দেখা যাবে, ঋণ খেলাপের সিংহভাগ নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক থেকে৷ বেসরকারি ব্যাংক থেকে খুব বেশি ব্যাড লোন বা খারাপ ঋণ নেয়া হয় না৷

বাম দলগুলির দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ভারতে এক ধরনের ক্রোনি ক্যাপিটলিজম চলছে৷ শিল্পপতি এবং রাজনীতিবিদদের যৌথ চক্রান্তে দেশের অর্থনীতি ক্রমশ মুখ থুবড়ে পড়ছে৷ লাখ লাখ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ আর যারা ঋণ খেলাপি, তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গোটা দেশে৷ যদি বা ধরা পড়ছেন বিদেশে গিয়ে থাকছেন বহাল তবিয়তে৷ তাদের টিকিও ছোঁয়ার উপায় নেই৷ ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, বিদেশ থেকে ঋণ খেলাপিদের ধরে আনবেন৷ ঋণের টাকা উদ্ধার করবেন৷ দুই দফা অতিক্রান্ত হতে চলল, এখনো পর্যন্ত এমন একজনকেও দেশে ফেরানো যায়নি৷

কয়েনের একটি উল্টো পিঠও আছে৷ ঋণ ফেরত দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন দেশের কৃষকরা৷ একবার নয়, বার বার৷ মোট ঋণ খেলাপের অংকের সামনে কৃষকদের মোট ঋণ খেলাপের পরিমাণ দশমিকের ভগ্নাংশে আসবে৷ ব্যাংক কিন্তু তাদের ছাড়ে না৷ ঋণ ফেরত চেয়ে রীতিমতো অত্যাচার চলে৷

এটাই বাস্তব৷ স্বাধীন ভারতে বার বার এমনই হয়ে এসেছে৷

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো