উত্তরণের পথে
সমাজ তাদের আলাদা করে দিয়েছে সেই কবেই! অটিজম, সেরিব্রাল পলসি, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত সন্তানরা নিজেদের মনের খোরাক তবে পাবে কোথায়? তাই কলকাতার ১৩ জন মা নিজেদের সন্তানদের জন্য নিজেরাই ‘উত্তরণ’ নামের সংস্থা তৈরি করেছেন৷
বন্ধুত্ব
সমাজে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয় না৷ সপ্তাহে ‘উত্তরণ’-এর একটা দিনের অপেক্ষা থাকে সকলের৷ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং বন্ধুত্বের চাহিদা মেটানোর কাজ উত্তরণ করে চলেছে ১০ বছর ধরে৷ ১৩ জন মায়ের উদ্যোগে এই সংস্থা তৈরি হয়েছিল কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই৷ শুধু ১৩ জন মায়ের প্রবল ইচ্ছেশক্তি আর কর্মদ্যোগ এখনও সংস্থাটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ ছবিতে ‘উত্তরণ’-এর দুই বন্ধু নিশাঞ্জন এবং কৌশিক৷
সম্ভাবনা
সমাজে অনেকের থেকে পিছিয়ে এরা৷ কিন্তু এদের মধ্যেও প্রতিভার স্ফূরণ লক্ষ্য করা গিয়েছে৷ সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত আইভি চক্রবর্তী রবীন্দ্রসংগীতে বি মিউজ পাশ করেছে৷ শৈশব থেকেই মা শিবানী আইভিকে নিয়ে লড়ে চলেছেন৷ আইভির হাত-পা নাড়ানোয় অসুবিধে৷ তাই তাকে কোলে নিয়েই বহু জায়গায় ছুটেছেন শিবানী৷ এমনকি মেয়ের জন্য গানও শিখেছেন মা৷ আইভি এখন পেশাদার গায়িকা হয়ে মঞ্চেও গাইতে চায়৷
জীবনের ক্লাস
‘উত্তরণ’-এ সপ্তাহে একটাদিন শেখানো হয় জীবনের পাঠ৷ এই বিশেষভাবে পারদর্শী ১৩টি শিশুদের জীবনের পাঠ দিতে আসেন প্রশিক্ষকেরা৷ সেখানে ভালো করে কথা বলার প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে ছোটখাটো হাতের কাজও করানো হয়৷ এই সংস্থার যাবতীয় খরচ বহন করেন ১৩ জন মা৷ ‘উত্তরণ’-এর নিজস্ব কোনো ঘর নেই৷ বিভিন্ন জায়গায় চলে এই প্রশিক্ষণ৷ তাই শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ মায়েরা সরকারি সাহায্য চান৷
শিক্ষা যখন মূর্ত
শিশুদের সামাজিক মেলামেশায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্কুল৷ কিন্তু যাদের তথাকথিত স্কুল নেই, তাদের জন্য ‘উত্তরণ’ স্কুলের ভূমিকা পালন করে৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারাই হয়ে ওঠেন শিক্ষার মূর্ত প্রতীক৷ পিতৃহারা নিশাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা মঞ্জুশ্রী তার একমাত্র অবলম্বন নয়৷ ‘উত্তরণ’-এর শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তার মতো অনেকের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন৷ অটিস্টিক নিশাঞ্জনের সঙ্গে শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস৷
জীবনের উৎসব
সমাজে উৎসব একটা বড় ভূমিকা পালন করে৷ তাই ‘উত্তরণ’-এ উৎসবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, হোলি, স্বাধীনতা দিবস থেকে শুরু করে যাবতীয় উৎসব ‘উত্তরণ’-এ পালন করা হয়৷ বিশেষভাবে পারদর্শীরাও এখানে নিজেদের মতো করে উৎসবের আনন্দ খুঁজে নেয়৷ ছবিতে কৌশিক দাস এবং সনমিত্র শীল ‘উত্তরণ’-এর ক্লাসে মেতে উঠেছে হোলির আনন্দে৷ সঙ্গে রয়েছেন মায়েরা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷
পারস্পরিক সম্পর্ক
সমাজ হয়ত এদের বঞ্চিত করেছে৷ কিন্তু এরা নিজেদের বঞ্চিত করেনি৷ সপ্তাহে একটা দিন এরা হইচই, আনন্দ, মজা করে নিজেদের মধ্যে৷ আইভির মতে, এই একটা দিন অক্সিজেনের মতো৷ গান, উৎসব, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা জীবনের সব রঙেই এই একটা দিন রঙিন হয়ে ওঠে৷ ছবিতে আইভির সঙ্গে তার বন্ধু এবং ‘উত্তরণ’-এর সদস্য সৌরভ সাহা৷
সবার পছন্দ একই
‘উত্তরণ’-এর সবাই মোটামুটিভাবে হইচই করতে খুব ভালোবাসে৷ কখনও এখানে পুতুল নাচের আয়োজনও করা হয়ে থাকে৷ পুতুল নাচে সবার খুব সক্রিয় ভূমিকা থাকে৷ পুতুল নাচের মতো মজাদার জিনিস খুঁজে দেওয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায়ই ফুচকা পার্টি বা মুড়ি মাখার আয়োজন করেন৷ এতেও সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে যোগ দেয়৷
পরিবার
পরিবারের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে হয়৷ তাই ‘উত্তরণ’-এ একটা দিন বন্ধুবান্ধবদের দেখার জন্য প্রতীক্ষাটা বড়ই দীর্ঘ হয়৷ আবার একটা দিন কেটে গেলে পরিবারে ফিরে যেতে হয়৷ লড়াইয়ের যাবতীয় কষ্ট থেকে ছোটছোট মুহূর্ত ভাগ করে নেয় পরিবার৷ ‘উত্তরণ’-এ পরিবারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ ছবিতে ক্লাস শেষে পরিবারের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে অর্ক৷