ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড: পরিবেশ ও দুর্নীতি
কলকাতা শহরের পূর্বপ্রান্তে ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড। ১২ হাজার বর্গ একরের এই জলাভূমি কলকাতার জলের প্রাকৃতিক ফিল্টার। কিন্তু সেই অঞ্চলেই চলছে দুর্নীতি এবং রাজনীতি।
কলকাতার নিকাশি
ভৌগলিকভাবে কলকাতা ভারতবর্ষের নিচু শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচমিটারেরও কম উচ্চতা বিশিষ্ট এই শহরের নিকাশিব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক প্রাকৃতিক রহস্য।
কলকাতার ঢাল পূর্বে
গঙ্গানদী বয়ে যাচ্ছে কলকাতা শহরের পশ্চিমে, অথচ শহরের ঢাল পূর্বে। এই শহরের দৈনিক ৭০০ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য কলকাতার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত এক জলাভূমিতে গিয়ে পড়ে। যার নাম ‘ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড’।
জলাভূমি ও বাস্তুতন্ত্র
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট এই জলাভূমি যে শুধুমাত্র শহরের বর্জ্যনিকাশেই সাহায্য করে তা নয়, ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড একটা আস্ত বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে চলেছে বছরের পর বছর।
প্রাকৃতিক ফিল্টার
সাড়ে ১২ হাজার একর বিস্তৃত এই বিশাল জলাভূমিতে বর্জ্য জলের জীবাণু জলজ বাস্তুতন্ত্রে শৈবাল ও মাছের খাদ্যে পরিণত হয়। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রেই সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় শহরের বর্জ্য জল পরিশুদ্ধ হয়। পুরো প্রক্রিয়াটাই প্রাকৃতিক। প্রশাসনকে এক পয়সাও খরচ করতে হয় না।
জলাভূমি ও জীবিকা
প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই জলাভূমির সঙ্গে। এই জলাভূমিতেই তৈরি হয়েছে অসংখ্য ভেড়ি। শহরের অনেক মাছ এখান থেকে আসে। আর আসে সংলগ্ন ক্ষেতের টাটকা শাকসব্জি।
রামসার সাইট
২০০২ সালে ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডকে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনের পর এটিই পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জলাভূমি।
জলাভূমি ও দুর্নীতি
পরিবেশবিদদের মতে, গত দশ-বারো বছরে পরিস্থিতি বদলেছে অনেকটাই। ‘রামসার সাইট’ হওয়ার কারণে কোনো ধরণের নির্মাণ এখানে আইনি নয়। অথচ সেটাই হচ্ছে।
বহুতলের বন্যা
জলাভূমি ভরাট করে গত দশ-বারো বছরে উঠেছে গগনচুম্বী বহুতল। ফলে, কলকাতা শহরের প্রাকৃতিক জলনিকাশি ব্যবস্থা ধাক্কা খাচ্ছে। সরকারি খরচে নির্মাণ করতে হচ্ছে পাম্পিং-স্টেশন।
বন্যার কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে আগাছার মত গজিয়ে ওঠা নতুন বাড়ি বন্যা-নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আদালতের নির্দেশ
উচ্চ-আদালতের নিষেধ সত্ত্বেও এই জলাভূমি ভরাট করে নগরায়ণ হচ্ছে। এতে রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে বলে মনে করে পরিবেশবিদদের একাংশ।
নদীর সঙ্গে যুক্ত
যে বিপুল পরিমাণ জলে প্রতিদিন ভেসে যেতে পারত কলকাতা, তার বেশিরভাগটাই টেনে নেয় এই জলাভূমি, তারপর অবশিষ্ট জল চলে যায় বিদ্যাধরী নদীতে।
সংকীর্ণ হচ্ছে খাল
বর্জ্যজল বিদ্যাধরী পর্যন্ত পৌঁছায় যে খাল ধরে, আজ সেই নালাগুলোর পাশেও গড়ে উঠেছে বসতি। সংকীর্ণ হয়েছে খালের প্রস্থভাগ।
ক্ষতি করছে হোর্ডিং
পরিবেশবিজ্ঞানী স্বাতী নন্দি চক্রবর্তীর কথায়, ''জলাভূমির পাশে লাগানো হোর্ডিংগুলোও এই জৈবিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী। আলোকিতকরণের জন্য হোর্ডিংয়ের নীচেই যে ইলেকট্রিসিটি জেনারেটর লাগানো হয় তা ওই জলের জীবাণু মেরে ফেলে। যে জীবাণু কারখানার বর্জ্য জলে ক্রোমিয়াম নিকেলের মত ধাতব মৌলের উপস্তিতির সঙ্গে লড়াই করে।
মাছচাষীদের অভিযোগ
এই অঞ্চলের মৎসচাষীদের অভিযোগ, আগে যেভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে বর্জ্য জল মাছের খাবার বয়ে আনত, জলাভূমি ভরাটের ফলে এখন সে ধারা অনেকটাই ব্যাহত। ফলে মাছ চাষের জন্য অনেকটাই বাইরের খাবারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
খালের উপর পিলার
বিশেষজ্ঞদের মতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ এই জলজ বাস্তুতন্ত্রকে এক বিশাল ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। নিকাশি খালের ওপর মেট্রোরেলের পিলার তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
খালের ময়লা খালেই
খাল ড্রেজিং করা হচ্ছে কিন্তু সেই ময়লা ফেলা হচ্ছে পাশের জলাভূমিতে। এতে জলাভূমির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এই পরিকল্পনাহীনতাকেও দূষছেন পরিবেশবিদদের একাংশ।