ইরানি চলচ্চিত্রকার শিরিন নেশাত
১০ জুলাই ২০১০শিরিন নেশাত একজন ইরানি চলচ্চিত্রকার৷ তিনি একজন পেশাগত ফটোগ্রাফারও৷ তবে ৯০এর দশকে তাঁর তোলা ছবি দিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, নাম, ‘আল্লাহর নারীরা'৷
সাত বছর আগে শিরিন নেশাত একটি ছবি তৈরি করেন৷ ছবির নাম ‘জানান বেদুন মার্দান' অর্থাৎ পুরুষ বিহীন নারী৷ ৫০-এর দশকের চার ইরানি নারীর জীবন কাহিনী নিয়ে এই ছবি৷ জুলাই মাসের এক তারিখে জার্মানিতে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে৷
ছবিতে যে চারজনকে দেখা গেছে তারা হলেন, একজন মহিলা, যার স্বামী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, একজন দুঃখকাতর প্রেমিকা, একজন যৌন কর্মী এবং আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এরকম একজন মহিলা৷ তারা জড়ো হয়েছেন একটি বাগানু৷ বাগানের এক পাশে মরুভূমি, অন্যপাশে জঙ্গল – আবার এই বাগানটিই হল রক্ষাব্যূহ৷ এই বাগানে চারজন মহিলা তাদের জীবনের দুঃখের কাহিনি শোনান একে অপরকে৷ ঘটনা শুরু হয় ১৯৫৩ সাল থেকে যখন ইরানের শাহ ক্ষমতায় এলেন৷ ছবি এবং গল্প দিয়ে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো তুলে ধরেছেন শিরিন নেশাত৷ সংগ্রাম, আশা, হতাশা এবং গ্লানির প্রতিটি ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর ছবিতে৷ শিরিন নেশাত বললেন, ‘‘৫০-এর দশকে মানুষের জীবন কেমন ছিল তা আমি এই ছবিতে দেখাতে চেয়েছি৷ এখনকার চেয়ে সেই সময় অনেক স্বাধীনতা ছিল মানুষের ৷ পশ্চিমের দেশ থেকে যে কেউ আসতো পারতো, আমাদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে মিশতে পারতো৷ ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল সবার৷ অথচ এখন জোর করে সবার ওপর ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷''
ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে অনেক কিছুই পাল্টে যায়৷ পাল্টে যায় শিরিন নেশাতের জীবনও৷ তিনি ধর্মে মুসলমান কিন্তু পশ্চিমা ধাঁচে জীবন-যাপন করেছেন, পড়াশোনা করছেন ক্যাথলিক স্কুলে৷ শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনার জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে অ্যামেরিকা চলে যান৷ এই চলে যাওয়ার আর একটি কারণ আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামি বিপ্লব৷ শিরিন নেশাত থেকে যান অ্যামেরিকায় তবে কাজ করতে থাকেন ইরানের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েই৷ শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে ইরানের নারীদের জীবন চিত্র তুলে ধরেন তিনি৷ আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ওম্যান অফ আল্লাহ্' ৯০-এর দশকে সাড়া জাগায়৷ শিরিন নেশাত জানান, ‘‘ইরান থেকে ইরানের নাগরিকদের বের করে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু ইরানিদের মধ্য থেকে ইরানকে বের করে দেওয়া অসম্ভব৷ এত বছর বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের পরও আমি একজন ইরানি৷ আবার অন্যদিকে আমি নিজেকে পশ্চিমী বিশ্বের একজন মনে করি৷ আমার মন-মানসিকতা, আমার পোশাক পরিচ্ছদ, আমার জীবন যাপন – সবকিছুই পশ্চিমের মানুষদের মত৷''
রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনভাবেই তিনি স্পষ্টভাবে সক্রিয় নন৷ ইচ্ছে করেই এতদিন তিনি তা এড়িয়ে গেছেন৷ কাজের মধ্যে দিয়েই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তিনি কী বলতে চান৷
শিরিন নিজেই জানালেন, ‘‘আমি নিজেকে একজন মুসলমান মনে করি৷ তবে আমি প্রতিদিন নামাজও পড়ি না৷ ইসলাম ধর্মকে অসম্মানও করি না৷ আমি বিশ্বাস করি, ধর্মীয় বিশ্বাস যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ সবার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত৷ এই ছবির মধ্যে দিয়ে ইসলাম ধর্মের প্রতি কোন অসম্মান আমি করিনি, প্রতিবাদও করিনি৷ আমি যা দেখেছি, যা আমার চোখে পড়েছে তা-ই আমি দেখাতে চেয়েছি৷''
২০০৯ সালে ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে শিরিন নেশাত আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠেন৷ ইরানের তরুণ প্রজন্মের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন তাঁকে ভাবিয়ে তোলে৷ তাঁর ভেতর এক ধরণের পরিবর্তন তিনি লক্ষ্য করেন৷ নৈতিকভাবে ইরানের তরুণ প্রজন্মকে তিনি সমর্থন করেন৷ তিনি মনে করেন, এই তরুণ প্রজন্ম এবং তিনি সবাই গণতন্ত্র, শান্তি এবং মানবাধিকারের জন্যই লড়ছেন৷ ২০০৯ সালের আন্দোলন তাঁকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ১৯৫৩ সালের ইরানে৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল-ফারূক