ইউরোস্টার: দ্রুতগতির ট্রেনের ২৫ বছর
ইংলিশ চ্যানেল হয়ে লন্ডন-ব্রাসেলস-প্যারিস দ্রুতগতির ট্রেন চলাচল শুরু হয় ঠিক ২৫ বছর আগে৷ এই সময়ে ২০ কোটিরও বেশি যাত্রী পরিবহন করেছে ইউরোস্টার৷
অ্যাংলো-ফ্রাঙ্কো রেলে জার্মান ট্রেন
ব্রিটেনকে বাকি ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করেছে এই রেল নেটওয়ার্ক৷ জার্মানির সিমেন্সের ডিজাইন করা ইউরোস্টার ট্রেন আপনাকে লন্ডন থেকে ব্রাসেলস পৌঁছে দিতে পারে মাত্র এক ঘণ্টা ৫০ মিনিটে, প্যারিসে মাত্র সোয়া দুই ঘণ্টায়৷
যৌথ স্বপ্ন
১৭৫১ সালে ইংলিশ চ্যানেল কীভাবে পাড়ি দেয়া যায়, তা নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ফ্রান্স৷ বিজয়ী প্রকৌশলী নিকোলাস ডেসমার্টেস একটি টানেল তৈরির প্রস্তাব দেন৷ ১৮৫১ সালে স্থপতি হেক্টর হোরেউ পরিকল্পনাটি আবার আলোচনার টেবিলে তুলে আনেন৷
ভেস্তে যাওয়া পরিকল্পনা
১৮৬১ সালে এবং তারপর আবার ১৯৭৪ সালে ফরাসি এবং ইংলিশরা ইংলিশ চ্যানেলের দুই পাশে খননকাজ শুরুর পরিকল্পনা করে৷ কিন্তু রাজনৈতিক কারণে দুইবারই পরিকল্পনা থেমে যায়৷ বাড়তে থাকা বাজেট এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল ইংলিশরা৷ আন্দ্রে বাসডেভান্ট ১৯৪৯ সালে দুই রেল টানেলের নতুন ডিজাইন তৈরি করেন৷
অবশেষে সিদ্ধান্ত
১৯৮১ সালে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন প্রাইভেট ফান্ডে টানেল তৈরির বিষয়টি পর্যালোচনা করতে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করে৷ জনগণ গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যায় এমন টানেলের পক্ষে থাকলেও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শুধু রেল চালু রাখার কথাই বিবেচনা করা হয়৷ ১৯৮৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ টানেল তৈরির চুক্তি সই করেন৷
কাজ শুরু
১৯৮৮ সালে টানেলের কাজ শুরু হয়৷ পরবর্তী আড়াই বছর ১৩ হাজার প্রকৌশলীর একটি দল ১১টি খনন মেশিন নিয়ে টানেলের কাজ শুরু করে দুই পাশ থেকে৷ প্রতিদিন খনন করা হতো ৭৬ মিটার৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে দুই পাশ থেকে আসা টানেল সাগরের নীচে যুক্ত হয়৷ ফরাসি ও ব্রিটিশ প্রকৌশলীদের দেখা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০ মিটার নীচে, ইংল্যান্ড উপকূল থেকে ৪ মাইল এবং ফরাসি উপকূল থেকে ১০ মাইল দূরে৷
আধুনিক বিশ্বের চমক
সাগরের নীচে ৩৭ দশমিক নয় কিলোমিটার জুড়ে এই টানেল৷ সাত দশমিক ছয় মিটার ব্যাসের দুইটি রেল টানেলে কয়েক মিনিট পরপরই দুই পাশ থেকে রেল চলাচল করে৷ দুই টানেলের মধ্যবর্তী স্থানে আরেকটি চার দশমিক আট মিটার ব্যাসের টানেল রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের সুবিধার জন্য৷ ১৯৯৪ সালে অ্যামেরিকান সোসাইটি অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারস এই টানেলকে আধুনিক বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে উল্লেখ করে৷
রানি যখন যাত্রী
১৯৯৪ সালের ৬ মে প্রথম ট্রেনটিতে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স যান রানি এলিজাবেথ৷ ফরাসি অংশে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট উপস্থিত ছিলেন৷ ১৯৯৪ সালের ৯ নভেম্বর থেকে লন্ডন-প্যারিস ও লন্ডন-ব্রাসেলস রুটে দিনে দুটি ট্রেন চলাচল শুরু হয়৷ এর ছয় মাস পর প্রতি ঘণ্টায় ট্রেন চলাচল শুরু হয় চ্যানেল টানেল দিয়ে৷
দারুণ গতি
ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম দ্রুত গতির ট্রেন নেটওয়ার্ক অনেক আগেই চালু করেছে৷ কিন্তু বাড়তি খরচের কথা বিবেচনা করে ব্রিটেন অংশে নতুন রেললাইন বসাতে দেরি হয়৷ ফলে তখনই ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার গতি তোলা সম্ভব হলেও ব্রিটিশ অংশে ইউরোস্টার ট্রেন চলতো ধীর গতিতেই৷ ২০০৭ সালে দ্রুত গতির লাইন চালুর পর যাত্রায় সময় কমেছে অন্তত ৩০ মিনিট৷
যোগাযোগ বেড়েছে
লন্ডন, প্যারিস আর ব্রাসেলসের পাশাপাশি সপ্তাহে কয়েকদিন প্যারিসের পাশে ডিজনিল্যান্ডেও থামে ইউরোস্টার৷ ফ্রান্সের লিও এবং মার্সেইতেও যায় এ ট্রেন৷ শীতের সময় এই লাইনে ফ্রান্সের আলপস অঞ্চলে চলে দ্রুত গতির স্নো ট্রেন৷ দুই বছর আগে ইউরোস্টারের নেটওয়ার্কে যুক্ত করা হয় আমস্টারডামকেও৷ প্রতি বছর প্রায় এক কোটি যাত্রী পরিবহন করে ইউরোস্টার৷
ব্রেক্সিটে বাড়বে দুর্ভোগ
প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হয় চ্যানেল টানেল ও ইউরোস্টার৷ কখনও টানেলের মধ্যে আগুন, কখনও যান্ত্রিক গোলযোগ আবার কখনও অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে যাত্রা বাতিল৷ ২০০৯ সালে ৭৫ হাজার যাত্রীর টিকেট বাতিল করা হয় নানা কারণে৷ টানেলে ঢোকার ফরাসি অংশে প্রায়ই শরণার্থীরা লাফিয়ে ট্রেনে উঠে ব্রিটেন যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন হলে দুই পাশের কাস্টমস পরীক্ষায় দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷