ইউরোপের মাঝখানে বস্তি
১৩ আগস্ট ২০১৩ইটালির আপুলিয়া অঞ্চল৷ গ্রীষ্মের দুপুরে সূর্য আগুন ঝরাচ্ছে, সেই সঙ্গে বইছে আগুনের হল্কার মতো বাতাস৷ তারই মধ্যে পুরনো পিচবোর্ডের বাক্স আর প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে তৈরি এক বস্তিবাড়ি৷ সামনে একটা ময়লার পাহাড়, যার উপর মাছি ভন ভন করছে৷ চতুর্দিকে এ ধরনের ঝুপড়ির পর ঝুপড়ি৷ কোথাও পানি নেই, বিদ্যুত নেই, বাথরুম-পায়খানা নেই৷ এই বস্তির বাসিন্দারা জায়গাটাকে তাদের ‘‘ঘেটো'' বলেন, হিটলারের আমলে ইহুদিরা যেভাবে থাকতো৷
ঝুপড়িতে ঢুকলে হয়তো দেখা যাবে, জনা পাঁচেক লোক নিজের নিজের বিছানার উপর শুয়ে৷ ঘরে আরো গোটা দশেক জাজিম পাতা৷ ঘর জুড়ে টাঙানো দড়িতে ঝুলছে জামাকাপড়৷ মাটিতে রাখা রয়েছে জুতোজোড়া, প্লাস্টিকের বাক্সে খাবার-দাবার৷ এই ঘরটাকেই ইব্রা ম'বাকে ফাল তাঁর ঘরবাড়ি বলে চিহ্নিত করেন৷
মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি!
পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত আরো বিশজন মানুষের সঙ্গে এই ঝুপড়িতে থাকেন ইব্রা৷ দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য বছর দশেক আগে সেনেগাল ছেড়ে পালিয়েছিলেন৷ ভাঙা নৌকায় জান হাতে করে সাগরপাড়ি দেওয়ার পর দক্ষিণ ইটালির উপকূলে পৌঁছান৷ কেন? ‘‘একটা ভালো চাকরি পাবার আশায় এখানে এসেছিলাম৷ ভালো টাকা কামাব, যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারি, সেনেগালে আমার পরিবারকে সাহায্য করতে পারি৷''
‘ইটালীয়রা যে কাজ করতে চায় না'
আজ ৩২ বছর বয়সি ইব্রা ছিলেন পেশায় ছুতোর৷ গোড়ায় কিছু কিছু কাজও পেয়েছিলেন, তবে ছুতোর মিস্ত্রি হিসেবে নয়: মাঠে, খামারে শাকসবজি বা ফল তোলার কাজ, কম মজুরির কাজ, যা ইটালীয়রা করতে চায় না৷ ইটালিতে আজ মন্দা চলেছে, কাজেই সে সব কাজও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে৷ ওদিকে ইব্রা এই বস্তিতে আটকা পড়েছেন৷ তাঁর আর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই৷ ‘‘গত তিন মাস ধরে আমি বাড়িতে কোনো টাকা পাঠাতে পারিনি৷ বাড়ির লোকেদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আমার কোনো চাকরি নেই, বাড়িতে পাঠানোর মতো টাকা নেই – কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে চায় না৷ আমি তাদের কথা ভুলে ইউরোপে মজা করছি বলে তাদের ধারণা৷''
মজুরিও যে খুব বেশি ছিল, এমন নয়: ঘণ্টায় সাড়ে তিন ইউরো৷ ইটালীয় আর আফ্রিকান মাফিয়া মিলিয়ে তৈরি ‘কাপোলারি' ওর চেয়ে বেশি মজুরি দেয় না৷ ইব্রা পারিশ্রমিক সংক্রান্ত একটা লিখিত চুক্তি চাওয়াতে, সে আবেদন নাকচ হয় এবং ইব্রা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন৷ আজ ইব্রা জানেন, চুক্তি করা চাকরি থাকলে, তিনি সেই চাকরি গেলে বেকার ভাতা পেতেন৷ কিন্তু এই সব বহিরাগত শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করায় কাপোলারির কোনো আগ্রহ কিংবা স্বার্থ নেই৷
শোষণের প্রণালী
প্রণালীটা হল এই যে, স্থানীয় চাষী ও খামারমালিকরা সস্তায় মজদুর যোগাড় করার কাজটা মাফিয়ার হাতেই ছেড়ে দেয়৷ মাফিয়া আবার ঐ শ্রমিকদের কাজ দেবার জন্য তাদের কাছ থেকে তাদের রোজগারের অর্ধেক দাবি করে৷ ওদিকে ইব্রার পক্ষে সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে সেনেগালে ফিরে যাওয়াটা ব্যক্তিগত পরাজয়ের মতো হবে৷ এ ছাড়া ফেরত যাওয়ার টিকিট কেনারও সামর্থ্য নেই৷ যেটুকু টাকা বাঁচিয়েছিল, তাও ফুরিয়ে আসছে৷ কাজেই সে আজ সারাদিন রাস্তার ধারের সবজির খামারগুলো ঘুরে দেখে, যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়৷
ইব্রার মতো হাজার হাজার আফ্রিকান এ ভাবেই ইটালির আপুলিয়া অঞ্চলে বাস করছে৷ তাদের অধিকাংশই বেআইনিভাবে ইটালিতে ঢুকেছে৷ শুধু এ বছরের প্রথম ছ'মাসেই আট হাজারের বেশি আফ্রিকান দক্ষিণ ইটালির উপকূলে পৌঁছেছে৷ তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে আসছে কাজের সন্ধানে এবং তাদের অনেকেই ইটালি ছেড়ে চলে যায়৷ যারা থেকে যায়, তাদের অনেকেই ইব্রার মতো সবজির খামারে কাজ করে, বেআইনিভাবে, কাপোরালির মতো অপরাধীচক্রের নিয়ন্ত্রণে৷
‘‘ঘেটো''-র দুরবস্থার কথা স্থানীয় মানুষেরা জানেন, কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই৷ স্থানীয় মেয়র বলেন চলতি অর্থনৈতিক সংকটের কথা৷ কিন্তু স্থানীয় এক ক্যাথলিক যাজক, যিনি এই দুর্ভাগাদের যতোদূর সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করে থাকেন, তিনি বলেন: ‘‘আমি যখন দেখি পুলিশ কিংবা অভিবাসন কর্মকর্তারা তাদের যা করা উচিত, তা করছে না, তখন আমার মনে হয়, তারাও হয়তো গোটা প্রণালীটার সঙ্গে যুক্ত, এই প্রণালীকে সমর্থন করে, বাঁচিয়ে রাখতে চায়৷ নয়তো দুনিয়ার ক্ষমতা হাতে থাকতেও তারা কিছুই করছে না কেন?''