ইউক্রেনকে প্রেমের চিঠি
ইউক্রেনের মেয়ে নাটালিয়া ভ্লাসেঙ্কো৷ যুদ্ধের আগে ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করতেন৷এখন তিনি খারসন শহরের মানুষদের নিরাপদ স্থানে পাঠানোর কাজে সহায়তা করছেন৷ ইউক্রেনকে তার লেখা প্রেমের চিঠি...
আমার প্রিয় ওডেসা
আমার হৃদয়টা ইউক্রেনের৷ আমি ঘুরে বেড়াতে আর নতুন নতুন স্থান আবিষ্কার করতে ভালোবাসি৷ তবে ঘরে ফিরলে আমি সুখ পাই৷ আমি ওডেসার মানুষ৷ ওডেসা সেই ছিমছাম শহর, যেখানে রয়েছে ইউরোপীয় স্থাপত্যের আদি নিদর্শন৷ ভিয়েনিজ স্থপতির তৈরি করা অপেরা থিয়েটার এবং শহরের প্রথম মেয়র ডিউক ডি রিশেলিউ-এর স্মৃতিস্তম্ভ সম্বলিত প্রিমোরস্কি বুলেভার্ড তো সেখানেই৷
শাস্ত কৃষ্ণ সাগর
ওডেসার খোলামন, সাগরের সঙ্গে নৈকট্য, এর ইতিবাচক পরিবেশ এবং সূর্যালোকে আলোকিত দিনের প্রাচুর্যের জন্য আমি ওডেসাকে ভালোবাসি৷ যুদ্ধের আগে সাগরের তীরে হাঁটতে, বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে আর সূর্যোদয় দেখতে ভালো লাগতো৷ কথায় আছে, সাগর যে কোনো দুঃখ প্রশমিত করতে পারে, অনেক ব্যথা ভুলিয়ে মন ভালো করে দিতে পারে৷ নিজের অভিজ্ঞতায় জানি- এসবই সত্যি৷
টুরিস্ট গাইড হিসেবে আমার কাজ
২০১৬ সালে আমি ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ শুরু করি৷ স্থাপত্যশিল্পের প্রতি ভালোবাসা আমার তীব্র৷ ডিগ্রি পাওয়ার পর তাই গাইডের কাজ করতে সুবিধা হয়েছে, ভালোও লেগেছে৷ ওডেসায় ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ মা নেই অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, সংস্কৃতি বিনিময়ের আনন্দ পাওয়া৷ গাইডের কাজ করার সময় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাদের অনেকেরএই দুঃসময়েও আমাকে মেসেজ পাঠিয়ে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে সহায়তা করেন৷
স্থাপত্যপ্রেম
কেউ যদি প্রশ্ন করেন আমি কী করতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আমার উত্তর হবে- হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন স্থাপত্যের ছবি তুলতে৷ পুরোনো ভবন, কাঠের দরজা, মার্বেল পাথরের সিঁড়ি- এসব খুবই ভালোবাসি৷ ওডেসার একটা অংশে পর্যটকরা তেমন যান না৷ সেইদিকটায় প্রায়ই হেঁটে বেড়াতাম৷ সেখানকার প্রাচীন আর বিশাল সব উঠোন দেখতাম৷ ওডেসার উঠোনগুলোর আরেক আকর্ষণ হলো বিড়াল৷ অনেক বিড়াল রয়েছে সেখানে৷
প্রাণবন্ত শহর লভিভ
ইউক্রেনে ওডেসার পর আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর লভিভ৷ লভিভকে ইউক্রেনের সংস্কৃতির রাজধানী বললেও ভুল হবে না৷ কফি আর চমৎকার সব ক্য্যাফের এই শহর নানা ধরনের উৎসব আর পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে বড় বইমেলার জন্য বিখ্যাত৷ চমৎকার কিছু স্থাপত্যও রয়েছে লভিভে৷ আমি সবসময় স্বপ্ন দেখি যুদ্ধ শেষ হলে আবার লভিভে যাবো, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, তাদের জড়িয়ে ধরবো, মার্কেট স্কয়ারে একসঙ্গে বসে কফি খাবো৷
লভিভের স্থাপত্য
বন্ধু ইরিয়ানার সঙ্গে আমি প্রায়ই বিখ্যাত স্থাপত্যগুলো দেখার জন্য লভিভে হেঁটে বেড়াতাম৷ ভবনগুলো দেখার সময় ভেতরের উঠোনগুলোতেও উঁকি মারতাম৷ সব সময় খুব সুন্দর কিছুর দেখা পাওয়ার আশা নিয়ে ঘুরতাম এবং হঠাৎ সেরকম কিছু পেয়েও যেতাম৷ কখনো হয়ত স্থাপত্যকর্মে মুগ্ধ হতাম, কখনোবা ভবনের ছাদ কিংবা মোজাইক করা মেঝের কোনো পেইন্টিংয়ে আটকে যেতো চোখ৷
কার্পেথিয়ানের পাহাড়
ইউক্রেনে সাগর আছে আবার ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ও আছে৷ বছরের যেকোনো সময়েই যান না কেন কার্পেথিয়ানের পাহাড়গুলো দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন৷ পাহাড় দেখতে আর হাইকিং করতে কত মানুষ যে ইউক্রেনে যেতো তার হিসেব নেই৷ একবার আমি প্লাইপেট গ্রামে জন্মদিন উদযাপন করেছিলাম ৷ প্রথম ক্যাবল কারে চড়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল তখন৷ সেই স্মৃতি কোনোদিন ভুলবো না৷
শান্ত এক ঐতিহাসিক শহর চেরনিহিভ
ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করার সময় সপ্তাহান্তে পর্যটকদের ওডেসা থেকে চেরনিহিভে নিয়ে যেতাম৷ খুব শান্ত শহর চেরনিহিভেও সুন্দর স্থাপত্যের অভাব নেই৷ পুরোনো অনেক গির্জাও আছে সেখানে৷ কোনো কোনো গির্জা প্রায় নয়শ বছর আগের৷ যতবার সেই শহরে বোমা বর্ষণের খবর পাই, প্রাণটা কেঁদে ওঠে৷
ইউক্রেনের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য হুমকির মুখে
ইউক্রেন কত সুন্দর তা বোঝানোর জন্য আমি শুধু কয়েকটা জায়গার কথা বললাম৷ ইউক্রেনের প্রতিটি স্থান নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুন্দর৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো অভাব নেই৷ আসকানিয়া নোভা বায়োস্ফেয়ার রিজার্ভ, গোলাপি হৃদ এবং টিউলিপের বাগানসমৃদ্ধ খারসন অঞ্চল থেকে শুরু করে খারকিভ পর্যন্ত যেখানে যাবেন সেখানেই দেখবেন প্রকৃতি সৌন্দর্যের ডালি মেলে আপনার অপেক্ষায়৷
ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ান
ইউক্রেনকে আর ইউক্রেনের স্বাধীনতাপ্রেমী সাহসি মানুষদের এখন যতটা ভালোবাসি এতটা মনে হয় আগে কখনো বাসিনি৷ আমরা আমাদের জীবনরক্ষার জন্য, আমাদের দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য, জাতি হিসেবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়ছি৷ রাশিয়ার আগ্রাসন আর প্রোপাগান্ডার সঙ্গে লড়ে আমরা ইউক্রেনের ভাষা এবং সংস্কৃতিকেও রক্ষা করছি৷ আমরা রাশিয়ার ভাই নই, কখনো ছিলাম না৷ আমরা আমাদের ভূখণ্ডে থাকি৷ আমরা স্বাধীন৷ আমরা ইউক্রেন৷