‘আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই!'
২৮ অক্টোবর ২০১৪প্রথমে ক্যানাডার মন্ট্রিয়ালে দু'জন সৈনিকের উপর গাড়ি নিয়ে আক্রমণ; তার দু'দিন পর অটাওয়ার স্মৃতিসৌধে প্রহরারত সৈনিকের বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু, এমনকি সংসদভবনে গুলিচালনার ঘটনা৷ এ সব আক্রমণে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু নির্বাচিত লক্ষ্য ছিলেন না – দুর্ভাগ্যক্রমে সন্ত্রাসীদের নজর পড়ে তাঁদের ওপর৷ গত মে মাসে ব্রাসেলস-এর ইহুদি সংগ্রহশালায় সংঘটিত সন্ত্রাসী আক্রমণে যারা প্রাণ হারান, কিংবা তার এক বছর আগে লন্ডনের রাজপথে যে ব্রিটিশ সৈন্যটিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় – সকলেরই আততায়ী ছিল গোঁড়া মুসলিম৷ পশ্চিমি দুনিয়ার বিভিন্ন মহানগরীতে এ ধরনের নির্বিচার আক্রমণ আতঙ্কের সৃষ্টি করে বৈকি৷ সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতিই হলো তাই৷
হ্যাঁ, জার্মানিতেও সে ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে – আজ নয়ত কাল৷ কেননা এ দেশে গোঁড়া মুসলিমের কোনো অভাব নেই৷ তাদের মধ্যে সাড়ে চার'শো নাকি ইতিমধ্যেই সিরিয়া কিংবা ইরাকে গিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস বা আইসিস-এ যোগদান করেছে৷ আরো বড় কথা, সেই জিহাদিদের মধ্যে শ'খানেক নাকি ইতিমধ্যে জার্মানিতে ফিরেও এসেছে, আরো বেশি জঙ্গি মনোবৃত্তি নিয়ে, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে৷ নির্মমতা তাদের সহ্য হয়ে গেছে৷ এই প্রত্যাবর্তনকারীরা হলো ‘টাইম বোমা'-র মতো, বলছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা৷
পূর্ণ নিরাপত্তা বলে কিছু আছে কি?
পশ্চিমের মানুষরা আজকাল সাইকেল চালানোর সময়েও হেলমেট পরেন, কেননা তারা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চান৷ কিন্তু বাস্তব সত্য হলো: চূড়ান্ত, চরম ও পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা কিংবা নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, অন্তত মন্ট্রিয়াল, অটাওয়া, ব্রাসেলস কিংবা লন্ডনের আততায়ীদের হাত থেকে নয়৷ তা-তে কি খুব দুঃখিত হবার কারণ আছে? জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আছে, যেখানে মানুষ চূড়ান্ত নিরাপত্তার প্রত্যাশা করে না: মোটরওয়ে-তে গাড়ি চালাতে গিয়ে, এমনকি বাড়ির জানলা পরিষ্কার করতে গিয়ে জার্মানিতে প্রতিবছর যত মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হন, সন্ত্রাসী আক্রমণে সারা বিশ্বে তত মানুষ প্রাণ হারান কিনা সন্দেহ৷
কাজেই ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টেফান হার্পার এক সপ্তাহে পর পর দু'টো আক্রমণের পর তাঁর দেশবাসীদের যা বলেছেন, সেটাই সত্য: ‘‘আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই৷'' এর অর্থ: আমরা একটা উন্মুক্ত সমাজে থাকতে চাই৷ আমরা আইনের শাসন বজায় রাখতে চাই৷ – সেই কারণেই পশ্চিমের মুক্ত সমাজব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনভাবে, কোনোরকম সন্দেহ ছাড়া বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে হবে – তা তারা খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুসলিম, বৌদ্ধ, অবিশ্বাসী, যা-ই হোক না কেন৷ সেই কারণেই পশ্চিমি দেশগুলিতে সবার জন্য অভিবাসনের পথ খোলা রাখতে হবে – শুধু খ্রিষ্টানদের জন্য নয়৷
বাঁচার মতো বাঁচা
কাজেই পশ্চিমের মানুষ স্বাধীন ও মুক্ত হয়ে বাঁচবে৷ তারা বড়দিনের মেলায় যাবে, স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখবে, তা সে ছেলেদের খেলাই হোক আর মেয়েদের খেলাই হোক! অর্থাৎ আমরা এ যাবৎ যেমনভাবে বেঁচেছিলাম, সেভাবেই বাঁচবো – কার কোথায় কোনো খারাপ মতলব থাকতে পারে, তা নিয়ে যথাসম্ভব কম মাথা ঘামিয়ে৷ কেননা একটি মুক্ত সমাজ হলো সর্বাগ্রে একটি সহিষ্ণু সমাজ – যদিও সে সমাজেও স্বাধীনতার সীমা আছে: তা যেন অপরের স্বাধীনতা খর্ব না করে৷
অপরদিকে জার্মানির ইতিহাসই তাকে শিখিয়ে দিয়েছে যে, রাষ্ট্রকে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে হবে; যে কারণে জিহাদি অপপ্রচার নিষিদ্ধ করাটা পুরোপুরি বৈধ এবং নীতিসম্মত৷ একটি সমাজের শক্তি প্রমাণিত হয় সংকটের সময়: সমাজ যখন তার শত্রুদের প্রতিও নীতি অনুযায়ী আচরণ করে৷ শুধুমাত্র সন্দেহের বশে টেলিফোনে আড়ি পাতা, গ্রেপ্তার করা, পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া কিংবা নাগরিকত্ব বাতিল করা – অথবা গুয়ানটানামো বন্দিশিবিরের মতো একটি আইন-বহির্ভূত স্থান সৃষ্টি করা – এ সব মুক্ত সমাজে হওয়া সম্ভব নয়৷ কেননা আইনের শাসন নিজেই একটা আদর্শ৷ কাজেই চরমপন্থিরা যদি ভিডিও ক্যামেরার সামনে এ দেশের নাগরিকদের শিরচ্ছেদও করে, তবুও আমরা তাদের আইন ও নীতি অনুযায়ী বিচার করব৷
অন্য কিছু করাটা হবে সন্ত্রাসবাদের জয়ের সমতুল৷