1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইলার ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা যায় ‘গাঙের স্কুলে’

২৭ আগস্ট ২০১০

ঘুর্ণিঝড় আইলার আক্রান্ত হবার এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে৷ কিন্তু এখনো সেখানে অনেক সমস্যা৷ মানুষ এখনো সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি৷ নানা সমস্যা তাদের৷

https://p.dw.com/p/OxTr
আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখনো ফিরে পায়নি নিজের বাড়িছবি: Rainer Hörig

সময়টা এখন অন্যরকম৷ আকাশে কালো মেঘের ভেলা৷ ঝুপ করে নেমে পড়ে বৃষ্টি৷ বাতাসের শন শন আওয়াজ৷ একটু দূরেই নদীর পানির ছপাৎ ছপাৎ শব্দ৷ এখানেই দেখা কয়েকটি শিশুর সঙ্গে৷

শিশু রুকনের স্কুল

শিশু রুকন, সমবয়সী কাজল আর সিরাজের হাতে তিনকোণা ছোট জাল৷ আমাদের দেখে থেমে গেলো৷ এ কথা, ও কথা, নানা কথা হলো ওদের সঙ্গে৷ জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা স্কুলে যাও না? আমার এমন প্রশ্নের উত্তরে একটু থেমে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো৷ তারপর উত্তর দিলো, স্কুলে যাই তো! ঐ যে গাঙ দেখছেন, আমরা সেই স্কুলে পড়ি! গাঙের স্কুল! এই উত্তরের পর আমি আর কি বলবো? এরা সকলে ঘূর্ণিঝড় আইলা আক্রান্ত এলাকার শিশুর দল৷

আইলা মানে ডলফিন!

ঘূর্ণিঝড় আইলার নামকরণ করেছিলেন মালদ্বীপের আবহাওয়াবিদরা৷ ‘আইলা' শব্দের অর্থ ডলফিন বা শুশুকজাতীয় জলচর প্রাণী৷ নামটি এই ঘূর্ণিঝড়ের জন্য নির্ধারণ করেন জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়া সক্রান্ত সংস্থা ‘ইউএন এস্কেপ'-এর বিজ্ঞানীরা৷ ২০০৯ সালের ২৫ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় আইলার৷ এর ব্যাস ছিলো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি৷ ঘূর্ণিঝড় আইলা পটুয়াখালি, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালির হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে৷

কিন্তু এরপর ‘গাঙের স্কুলে'

এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হবার পর কি হচ্ছে সেখানে? একটু আগে বলছিলাম খুলনার দাকোপ উপজেলা সংলগ্ন একটি ইউনিয়নের শিশুদের শিক্ষার কথা৷ আইলায় ভেসে যায় সেখানকার সব স্কুল৷ আইলার এক বছর পরও স্কুলগুলোর পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়নি৷ আর কিছু স্কুল চালু হলেও, স্কুলের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশেরই জীবনে ঘটে গেছে বিশাল পরিবর্তন৷

ওরাই এখন পড়ে ‘গাঙের স্কুলে'৷ এটা আবার কি ধরণের স্কুল? উত্তরে জানতে পারি, সেখানকার শিশুরা স্কুলে না গিয়ে সারাদিন নদীতে পায়রা মাছের পোনা ধরে, গাঙ-ই এখন ওদের স্কুল৷ স্কুলে কেন যায় না জানতে চাইলে রুকন বলে, আইলার আগে ওর বাবা জুম্মত আলীর দোকান ছিল, এখন বেকার৷ মাঝে মাঝে পরের নৌকা ভাড়া নিয়ে মাছের পোনা ধরে, যাতে ওদের সংসার চলে না৷ ওর মা প্রায় সারাদিন ব্যস্ত থাকে খাবার পানির সন্ধানে৷ তাই ও স্কুলে না গিয়ে নদীতে পায়রা মাছের পোনা ধরতে যায়৷ একটা পোনা বিক্রি হয় ৬০ পয়সা থেকে ৭০ পয়সায়৷ রুকন সারাদিনে ৩০ থেকে ৫০টি পায়রা মাছের পোনা ধরতে পারে, যা থেকে তার আয় হয় ২০ থেকে ৩০ টাকা৷

বাঁধ ভাঙছে, গড়ছে না

দেখা যাচ্ছে, আইলার রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনার দাকোপ উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙ্গন ও ফাটল দেখা দিয়েছে৷ এর ফলে জনজীবন হয়ে উঠেছে বিপন্ন৷ গত দু'মাসে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে৷ দীর্ঘ ১৪ মাসেও আইলায় বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্কার করতে না পারায়, নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷

আইলার আগে এমন অনেক জায়গা ছিল যেখানে এক সময় ধানের জমি ছিল৷ ছিল পুকুরের মাছ, গোয়ালে গরু৷ এখন সেখানে সেগুলোর কোন চিহ্ন নেই৷ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে লবন৷ পানি উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘ ১৪ মাসেও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে না পারায়, চলতি বর্ষা মৌসুমে নদীর ভাঙ্গন প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ কবে এই বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার হবে, কবে তারা বাড়ি ফিরতে পারবে - তা কেউ বলতে পারছে না৷

ভরসা ভিজিএফ

একমাত্র ভিজিএফ কার্ডের ২০ কেজি চালই তাদের ভরসা৷ কিন্তু ওতে কি আর সংসার চলে? এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ এখন নদীতে চিংড়ি মাছের পোনা ধরতে যায়৷ তারা ধরে বাগদা, গলদা ও পায়রা মাছের পোনা৷ মহাজনের জাল-নৌকা ভাড়া নিয়ে ওরা পোনা ধরে, যা পায় তা মহাজনের কাছে বিক্রি করে৷ গাঙের স্কুলের শিশুরা আবার স্কুলে যেতে চায়... বলে, ‘‘আগে আমরা সবাই স্কুলি যাতাম, এহন গাংগে পায়রা মাছের পুনা ধরতি যাই, আমাগের স্কুলি যাতি ইচচ্ছ করে, আমরা কি আবার স্কুলি যাতি পারবো?''

প্রতিবেদন: সাগর সরওয়ার

সম্পাদনা: দেবারতি গুহ