অশান্ত হচ্ছে উত্তর-পূর্ব
১১ জানুয়ারি ২০১৯ভারতের যে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ, তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের আনা নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী প্রস্তাব৷ এই বিলে নাগরিকত্বের আবেদন বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে৷ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশে ধর্মের ভিন্নতার কারণে বিদ্বেষের শিকার যে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ, ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দিতে চায় সরকার৷ এবং যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে এই সুযোগ, মুসলিমদের রাখা হয়েছে তার আওতার বাইরে৷ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এই বিল৷ বিরোধীদের বড় অংশের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভারতীয় সংসদের নিম্নতর কক্ষ লোকসভায় সদ্য পাস হয়ে গেছে বিতর্কিত বিলটি৷ যদিও এরপর রাজ্যসভায় এই বিল পাস হবে কিনা, সন্দেহ আছে সে নিয়ে৷ কিন্তু এর মধ্যেও উত্তাল হয়ে উঠেছে অসম এবং ক্রমশ উত্তর-পূর্ব ভারতের বাকি রাজ্যগুলিও৷
তার সবথেকে বড় কারণ, সীমান্তপার উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে সবথেকে জেরবার রাজ্যটি হলো আসাম৷ সেখানে অভিবাসী বাঙালিদের ওপর একসময় এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন অসমীয়ারা, যে শুরু হয়েছিল বাঙালি খেদাও আন্দোলন, জঙ্গি গোষ্ঠী ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম, অর্থাৎ উলফার জন্ম হয়েছিল, যারা আসামকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করারও ডাক দিয়েছিল৷ ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ অবধি চলা সেই জঙ্গি আন্দোলনকে শান্ত করতে কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছিল আসাম চুক্তি, যাতে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল যে, ২৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখের আগে যাঁরা আসামে থাকতে এসেছিলেন, শুধু তাঁদেরই থাকতে দেওয়া হবে৷ তারপর যাঁরাই এসেছেন, তাঁদের বহিষ্কার করা হবে৷ কিন্তু নতুন এই নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী কার্যত খারিজ করছে ওই আসাম চুক্তির মৌলিক শর্ত৷ আসামবাসীর প্রথম রাগ এখন এখানেই৷ আর তাঁদের দ্বিতীয় আপত্তি, যদি ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তই হবে, তাহলে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে নাগরিক পঞ্জিকরণ, অর্থাৎ এনআরসি চালু করার কী দরকার ছিল? সীমান্তের রাজ্যগুলিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতেই বৈধ নাগরিকদের পঞ্জিকরণের এই উদ্যোগ সরকারের, তা পুরোটাই বেকার হয়ে যাবে, যদি নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীটি হয়৷
এবং এই রাগ আর বিরক্তির ফলাফল এখন বিজেপির জন্যে খুব বড় সমস্যা হয়ে উঠতে চলেছে৷ আসামে এর মধ্যেই একদিন বন্ধ পালিত হয়েছে এবং কেন্দ্রে এনডিএ ও রাজ্যের শাসকজোট থেকে বেরিয়ে এসেছে আসামের মুখ্য রাজনৈতিক দল আসাম গণ পরিষদ৷ ইস্তফা দিয়েছেন রাজ্য মন্ত্রিসভায় আসাম গণ পরিষদের তিন মন্ত্রী৷ খাতায় কলমে বিজেপি আসামে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে চলেছে৷ এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে একমাত্র সমর্থন জোগাতে পারত বড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট, কিন্তু তারাও এখন বেঁকে বসেছে৷ মঙ্গলবার অসমীয়া ছাত্র সংগঠন আসু’র ডাকা বন্ধের দিন রাজ্যের সবক'টি রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থনই প্রমাণ করে দিয়েছে, নাগরিকত্বের ইস্যুতে আসামের সবকটি দল একজোট৷ এমনকি অসম বিজেপির মধ্যেও বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিচ্ছে৷ বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যেও৷ মেঘালয়ে বিজেপির সঙ্গ ছাড়ছে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি৷ শিলংয়ে বিজেপি দপ্তরে হামলাও হয়ে গেছে এর মধ্যে৷ ত্রিপুরাতেও খেপে উঠেছে উপজাতি সম্প্রদায়গুলো৷ সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, লোকসভা ভোটের আগে মোদী সরকারের এক বড় সমস্যা হয়ে উঠতে চলেছে উত্তর-পূর্ব ভারত৷