1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘অরেঞ্জ অ্যালার্ট’ উড়িয়ে দিয়ে শেষ চারে আর্জেন্টিনা

সামীউর রহমান
৯ ডিসেম্বর ২০২২

২০১৪’র সাও পাওলো ফিরে এলো ২০২২ এর লুসাইল স্টেডিয়ামে৷ বিশ্বকাপের নকআউটে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডস এবং টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার জয়৷

https://p.dw.com/p/4Kl72
মেসি আর আলভারেজের সঙ্গে গোল উদযাপন করছেন মোলিনা
মেসি আর আলভারেজের সঙ্গে গোল উদযাপন করছেন মোলিনাছবি: Ricardo Mazalan/AP/picture alliance

লুই ফন খালের দলের খানিকটা উন্নতি, এবার হারের ব্যবধানটা টাইব্রেকারে ৪-৩, ৮ বছর আগে যা ছিল ৪-২৷

নাটকীয়ভাবে শেষ সময়ে সমতা ফিরিয়ে আনে নেদারল্যান্ডস, নির্ধারিত সময়ের ম্যাচটা ২-২ সমতায় শেষ হয়৷ এরপর অতিরিক্ত সময়ে কোনো গোল হয়নি, খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে৷ লাউতারো মার্তিনেজের শটটা গোলে ঢুকতেই নিশ্চিত হয়ে যায়, আর্জেন্টিনা খেলছে সেমিফাইনালে৷

৯ ডিসেম্বরের রাতটা ছিল টাইব্রেকারের৷ আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ আগে টাইব্রেকারেই হেরে বিদায় নিয়েছে ব্রাজিল, নানান নাটকীয়তায় আর্জেন্টিনাও তাদের সঙ্গী হওয়ার পথে৷ কিন্তু ফুটবল ঈশ্বর হয়তো লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপে শিরোপাটা তার জন্যই বরাদ্দ রেখেছেন৷ এত নাটকীয়তা, শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের পর আর্জেন্টিনার জয় তো সেরকমই আভাষ দেয়৷

আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছিলেন রদ্রিগো দি পল আর আনহেল দি মারিয়াকে নিয়ে অহেতুকই আশংকা করা হচ্ছে৷ একাদশ ঘোষণার সময় জানা গেল, দি পল শুরুর একাদশে থাকলেও দি মারিয়া নেই৷ স্কালোনি ছক সাজালেন ৫-৩-২ কৌশলে, রক্ষণ আরেকটু জমাট করে উইংয়ে খেলার সুযোগ করে দিলেন দুই উইংব্যাক মোলিনা আর আকুনিয়াকে৷ অন্যদিকে লুই ফন খাল কৌশল সাজিয়েছিলেন ৩-৪-১-২ ছকে৷ আগের ম্যাচের শুরুর একাদশ থেকে ডেভি ক্লাসেন নেই, দলে নিলেন স্টিভেন বার্জউইনকে৷

নেদারল্যান্ডসের প্রথম গোল উদযাপন করছেন ভ্যাখহর্স্ট
নেদারল্যান্ডসের প্রথম গোল উদযাপন করছেন ভ্যাখহর্স্টছবি: Peter Byrne/empics/picture alliance

তবে লিওনেল মেসির পায়ের জাদুর কাছে যেন পৃথিবীর সব কৌশলই বৃথা৷ মাঝমাঠের একটু পর থেকে, গোলপোস্টের ৪০ গজ দূর থেকে বল পায়ে মেসির সেই ক্ষিপ্র গতির দৌড়, একটা ঝটকায় নেথান আকে কে পেছনে ফেললেন তারপর ড্যানি ব্লিন্দ আর ভার্জিল ফান ডাইকের মাঝে সূঁচের মতো ফাঁকের ভেতর দিয়ে বলটা ঠেলে দিলেন ডি বক্সের ভেতর৷ যেখানে দুজনকে ছিটকে ফেলে ঢুকে পড়েছেন মোলিনা৷ রক্ষণের প্রহরীকে ছিটকে ফেলে বলটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নোপার্টকে বোকা বানিয়ে বল পাঠিয়ে দিলেন জালে৷ আর্জেন্টিনার হয়ে মলিনার এটাই প্রথম গোল, যে গোলটা মনে করিয়ে দিল ১৯৯০’র বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যারাডোনা আর ক্যানিজিয়ার যুগলবন্দীতে হওয়া সেই গোলটাকেই৷

প্রথমার্ধে মেসি পেয়েছিলেন আরো একটা ভাল সুযোগ, ম্যাচের ৪০ মিনিটে আলভারেজের পাস থেকে গোলরক্ষকের সোজাসুজি বল পেয়েছিলেন মেসি৷ কিন্তু ডানপায়ে নেয়া মেসির শটটা সোজাসুজি চলে যায় নোপার্টের হাতে৷ ডাচরা মূলত সুযোগ সৃষ্টি করেছে সেট পিসে৷ কিন্তু কোডি গাকপোকে কোনো ক্রসেই মাথা ছোঁয়াতে দেয়নি আর্জেন্টিনার রক্ষণ৷

ম্যাকঅ্যালিস্টারের ব্রেক থেকে একসঙ্গে আক্রমণে উঠেছিলেন মেসি, দি পল আর আলভারেজ৷ দি পল এগিয়েও গিয়েছিলেন, কিন্তু সময়মতো ধরতে পারেননি ম্যাকঅ্যালিস্টারের পাঠানো বলটা৷ হলে হয়তো আরেকটা গোল পেতেই পারত আর্জেন্টিনা৷ মিনিট খানেক পর মেসিকে ডি-বক্সের ঠিক সামনে ফাউল করেন ফান ডাইক৷ মেসির নেয়া ফ্রি কিকটা অল্পের জন্য গোলপোস্ট মিস করে গিয়ে লাগে সাইডনেটে৷

৬৫মিনিটের মাথায় দি পলকে তুলে পারেদেসকে নামান স্কালোনি, তারপর দলকে নিয়ে আসেন লো-ব্লক ডিফেন্সে৷ নেদারল্যান্ডস বারবার চেষ্টা করছিল ডান প্রান্ত দিয়ে ফ্রেঙ্কি দি ইয়ংয়ের গতিটা কাজে লাগিয়ে আক্রমণে উঠে আসার৷ কিন্তু আটজনকে রক্ষণে এনে কড়া পাহারাই বসিয়েছেন স্কালোনি, দি ইয়ংয়ের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না এই কড়া পাহাড়া গলিয়ে মেমফিস ডেপাই কিংবা কোডি গাকপোর কাছে বল পাঠানো৷

গোল করার পর মেসি
গোল করার পর মেসিছবি: Ariel Schalit/AP/picture alliance

খানিকটা সময় রক্ষণে নিজেদের ভেতরেই বলের দখল রাখার পর আক্রমণে আর্জেন্টিনা৷ বামদিক থেকে বক্সের ভেতর ঢুক্তে চেষ্টা করা আকুনাকে ফাউল করলেন ডামফ্রিস, সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির সংকেত রেফারির৷ পোল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টিতে গোল করতে না পারলেও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে একই ভুল করলেন না মেসি৷ বাম পায়ে ডানদিকে জোরাল শটে নোপার্টকে একদমই সুযোগ দেননি মেসি৷ এই গোলে আর্জেন্টিনার হয়ে ১৭০ ম্যাচে ৯৫ গোল হয়ে গেল মেসির আর বিশ্বকাপে গোলসংখ্যা হয়েছে ১০৷ আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা এতদিন ছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে গোল করে ‘বাতিগোল’কে ছুঁয়ে ফেললেন মেসি৷

ওদিকে লুই ফন খাল মাঠ থেকে ড্যানি ব্লিন্দকে তুলে নিয়ে লুক দে ইয়ংকে নামিয়েছেন, মেমফিস দেলেও কেও তুলে নিয়ে নামান ভ্যাখহর্স্টকে৷ ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্ট্রাইকারকে নামানোয় কাজ হয়েছে, গাকপোর ক্রসের রিবাউন্ডে ১২ গজ দূর থেকে লাফিয়ে মাথা ছুঁইয়ে ব্যবধান কমিয়ে ২-১ করেন ভ্যাখহর্স্ট৷ তার গোলের দেড় মিনিট পরেই ব্যার্কহয়সের শট লাগে জালের বাইরের দিকে৷ শেষ সময়ে মরিয়া হয়ে ওঠা ডাচদের সঙ্গে মাঠে লড়াই বেঁধে যায় আর্জেন্টাইনদের৷ পারেদেস ফাউল করেন আকেকে, এসময় বলটা তিনি লাথি মেরে মাঠের বাইরে পাঠাতে গিয়ে পাঠিয়ে দেন ডাচ ডাগআউটে৷ সঙ্গে সঙ্গে মাঠের ভেতরে চলে আসেন সাইডবেঞ্চের খেলোয়াড়রা৷ হাতাহাতি, কথা কাটাকাটির পর পারেদেসকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন রেফারি৷ সেই ফাউলের ফ্রি-কিকে একটা সুযোগ পেয়েছিল নেদারল্যান্ডস, কিন্তু ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে পারেননি কেউই৷

১০ মিনিট ইনজুরি সময় যোগ হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিটের সঙ্গে, যে সময়টা শেষ চেষ্টা হিসেবে আক্রমণ চালিয়ে গেছে নেদারল্যান্ডস৷ মূলত সেটপিসে আর লম্বা ক্রসেই গোল বের করার চেষ্টা ছিল তাদের৷ শেষ সময়ে সফল হল তাদের কৌশল৷ পেজেল্লা বক্সের বাইরে শুধু শুধু ধাক্কা দিলেন ভ্যাখহর্স্টকে৷ রেফারি দিলেন ফ্রি কিকের সংকেত, তর্ক করতে এসে হলুদ কার্ড দেখেন মেসি৷

সেই ফ্রি-কিকেই গোলের বন্ধ দরজা খুলল নেদারল্যান্ডস৷ কুপমেইনার্স উড়িয়ে শট না নিয়ে গড়িয়ে দিলেন ভ্যাখহর্স্টকে, বল পেয়েই এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে বোকা বানিয়ে বল জালে ঠেলে দিলেন৷ ১০১ তম মিনিটে গোল খেল আর্জেন্টিনা, কিক-অফের পরই রেফারির বাঁশিতে খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে৷

২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে লুই ফন খালই ছিলেন ডাচদের কোচ৷ ম্যাচটা টাইব্রেকারে গড়িয়েছিল আর জিতেছিল আর্জেন্টিনা৷ এবারও তার একই কৌশল৷ রক্ষণে সবাইকে নামিয়ে এনেছিলেন কোচ৷ সেই সুযোগে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে অনেকগুলো আক্রমণ করেছে আর্জেন্টিনা, একটার পর একটা কর্নার আদায় করেছে৷ লাউতারো মার্তিনেজের শট গোলরক্ষক ফিরিয়েছেন, এনজো ফার্নান্দেজের শট পোস্টে লেগে ফিরে এসেছে, মেসির শট গেছে পোস্টের পাশ দিয়ে৷ গোলের অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েও গোল আর করতে পারেনি আর্জেন্টিনা৷ বরং স্নায়ুর চাপে দুই দলের খেলোয়াড়রাই বারবার মেজাজ হারিয়েছেন, ফলে রেফারিকে বার বার দেখাতে হয়েছে কার্ড৷ গোটা ম্যাচে মোট ১৪ জনকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছেন স্প্যানিশ রেফারি আন্তোনিও লাহোজ৷

ফান ডাইকের নেয়া পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিচ্ছেন মার্তিনেজ
ফান ডাইকের নেয়া পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিচ্ছেন মার্তিনেজছবি: Ricardo Mazalan/AP Photo/picture alliance

পেনাল্টি শুট আউটে ফান ডাইকের নেয়া প্রথম শটটাই ঠেকিয়ে দিলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ৷ অন্যদিকে মেসি প্রথম স্পটকিক নিতে এসে করলেন গোল৷ দুই অধিনায়কের মতোই হলো দুই দলের ভাগ্য৷ ডাচদের পরের শট ব্যার্কহয়সের, মার্তিনেজ ঠেকিয়ে দিলেন সেই শটও৷ প্রথম দুই শটে আর্জেন্টিনার দুই গোল, ডাচদের কোন গোল নেই৷ দলের চতুর্থ শটে এনজো ফার্নান্দেজ মারলেন পোস্টের বাইরে৷ শেষ শটটা নিতে এলেন লাউতারো মার্তিনেস, এবারে মিস হলে সাডেন ডেথ৷ মাঠের খেলায় অনেকগুলো সুযোগ মিস করলেও লাউতারো এবারে আর মিস করেননি৷ দারুণ শটে গোল করে আর্জেন্টিনার জয় নিশ্চিত করলেন এই ফরোয়ার্ড৷

মেসি এবং দুই মার্তিনেজ, তাদের পায়ে এবং হাতে ভর করেই সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা৷ বিশ্বকাপ শিরোপা থেমে মেসি আর মাত্র দুই ম্যাচ দূরে৷ অন্যদিকে ডাচদের কষ্টটা বাড়ল, শেষ সময়ে গোল করে সমতা ফিরিয়ে ম্যাচের আয়ু বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত বাড়ির পথই যে ধরতে হচ্ছে তাদের৷ আর আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠার লড়াইতে মুখোমুখি হবে ব্রাজিলকে হারিয়ে আসা ক্রোয়েশিয়ার৷