1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অঘটনের বিশ্বকাপ, মেসি-এমবাপ্পের বিশ্বকাপ

এ কে এম খাদেমুল হক
১৬ ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্বকাপ মানে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’৷ সারা বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে যে আসরের দিকে, তার জন্য এরচেয়ে ভালো অভিধা আর কী হতে পারে!

https://p.dw.com/p/4L4IW
বিশ্বকাপের বলে পেছনে কাতারের স্কাইলাইন
কাতার বিশ্বকাপটা বোধ হয় সেই ‘গ্রেটেস্ট শো’-এর মধ্যেও থাকবে অনন্য এক উচ্চতায়৷ছবি: David Ramos/Getty Images

কাতার বিশ্বকাপটা বোধ হয় সেই ‘গ্রেটেস্ট শো’-এর মধ্যেও থাকবে অনন্য এক উচ্চতায়৷

কী নামে ডাকা যায় একে? অঘটনের বিশ্বকাপ? যেভাবে শুরু হয়েছিল আসরটি, তাতে এই নামটাই সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছিল৷ টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচেই তো ঘটে গিয়েছিল অবিশ্বাস্য এক অঘটন৷ অখ্যাত সৌদি আরবের কাছে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসির দল আর্জেন্টিনার হার৷ টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফিফার র‌্যাংকিং অনুসারে আর্জেন্টিনা ছিল বিশ্বের তৃতীয় সেরা দল, আর সৌদি আরবের র‌্যাংকিং পঞ্চাশের পরে৷ সেই সৌদি আরবের কাছে আর্জেন্টিনার হার, অঘটন তো মানতেই হয়!

তবে এখানেই শেষ নয়, অঘটনের পর্ব অব্যাহত ছিল আসলে কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি৷ প্রথম রাউন্ডেই এ রকম অপ্রত্যাশিত ফলাফলের শিকার হয়েছে প্রায় সব বড় দলই৷ র‌্যাংকিংয়ের বিশ্বসেরা ব্রাজিল হেরেছে ক্যামেরুনের কাছে, দ্বিতীয় সেরা বেলজিয়াম তো মরক্কোর কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে প্রথম রাউন্ড থেকেই৷ একই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সফলতম দলগুলোর একটি, জার্মানিকেও৷ জাপানের কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে তাদের৷ প্রথম রাউন্ডে টিউনিশিয়ার কাছে হেরেছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, ইরানের কাছে হেরেছে ওয়েলস, দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরেছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালও৷ তবে এত অঘটনের পরও অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডের হিসেব-নিকেশ গোলমেলে হয়নি খুব একটা, বেলজিয়াম-জার্মানি ছাড়া সব বড় দলগুলোই আসলে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে প্রত্যাশিতভাবে৷ কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে শুরু হয়েছে আরো বড় অঘটনের পালা৷ যার প্রথম শিকার স্পেন, মরক্কোর কাছে হেরে শেষ ষোলো থেকে ফিরে যেতে হয়েছে তাদের৷ আর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ঝরে যেতে হয়েছে ব্রাজিল-পর্তুগালকেও৷ এতগুলো অঘটন ঘটেছে যে বিশ্বকাপে, তাকে অঘটনের বিশ্বকাপ না বলে উপায় আছে?

এই যে এত ‘অঘটন', এর অন্য দিকটাও কিন্তু মনে রাখা দরকার৷ ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা অনেক বছর ধরেই বাড়িয়ে চলেছে বিশ্বকাপের পরিধি৷ এবারের বিশ্বকাপে যে ৩২টি দল খেলছে, তার মধ্যে বিশেষ করে এশিয়ার পাঁচটি (স্বাগতিক কাতারকে ধরলে ছয়টি) দলের সুযোগ পাওয়াকে বাঁকা চোখে দেখেন অনেকেই৷ ফুটবলের পাওয়ার হাউস হিসেবে বিবেচিত ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকা থেকে বরং আরো বেশি করে দল নেয়া হলে খেলাটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে তাদের মধ্যে৷ ইউরোপ অঞ্চলের বাছাইপর্বে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে ইতালির মতো দলের সুযোগ না পাওয়া তাদের যুক্তির পক্ষেই কথা বলে৷ কিন্তু জাপান-কোরিয়ার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা আর ইরান-সৌদি আরবের চমক বলছে, এশিয়াও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে৷

তবে এশিয়ার চমককেও ছাড়িয়ে গেছে আফ্রিকার দেশ মরক্কোর রূপকথার মতো উত্থান৷ ইউরোপের ‘বড়' দল বেলজিয়াম-স্পেন-পর্তুগালকে একের পর এক ধরাশায়ী করে আশরাফ হাকিমিরা প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে উঠে গেছে সেমিফাইনাল পর্যন্ত৷ সেখানে যদিও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সঙ্গে পারেনি, কিন্তু দুর্দান্ত লড়াই করে জিতে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ ফুটবলভক্তের হৃদয়৷ জয়ের পর ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে তাদের উৎসব কাতারের মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শককে দিয়েছে অন্য রকম একটা বার্তা৷

এই ‘অন্য রকম' আবহ অবশ্য শুরু থেকেই ঘিরে আছে এবারের বিশ্বকাপকে৷ নানা কারণেই এবারের বিশ্বকাপ অন্য রকম৷ সারা বিশ্বের পেশাদার ফুটবল লিগসমূহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বিশ্বকাপের আসর বরাবরই হয়ে এসেছে জুন মাসের বিরতিতে৷ কিন্তু এই আসরটির খেলা যেহেতু মরুভূমির দেশ কাতারের মাঠে, জুনের প্রচণ্ড দাবদাহের কথা বিবেচনায় রেখে তাই খেলার সময় বদলে নিয়ে আসা হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে৷ শুধু কি তা-ই! ম্যাচ শুরু-শেষের টাইমিংয়েও আছে নতুনত্ব, গুরুত্বপুর্ণ ম্যাচগুলো সব শুরু হয়েছে এমন সময়ে, যে তা শেষ হতে হতে গড়িয়ে গেছে স্থানীয় সময়ের হিসেবে মধ্যরাত৷ মুসলিম দেশ কাতারের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি লক্ষ্য রেখে গ্যালারি-র আইন-কানুনও বদলানো হয়েছে অনেকখানি, খোলামেলা পোশাক আর অ্যালকোহলিক বেভারেজ হয়েছে নিষিদ্ধ৷ এমনকি ফিফার স্পনসর কোম্পানিও পায়নি তাদের তৈরি বিয়ার বিক্রির অনুমতি৷ তাতে গ্যালারির চেহারা খানিকটা বদলেছে বটে, কিন্তু মাঠের ফুটবল আর গ্যালারির দর্শকদের মেলবন্ধনের ক্ষেত্রে তাতে যে খুব একটা পার্থক্য তৈরি হয়েছে তেমনটা বলা যাবে না৷

কাতার বিশ্বকাপ শেষে স্টেডিয়ামগুলোর কী হবে?

আয়োজনের অভিনবত্বের কথাও খানিকটা বলতেই হয়৷ উপসাগরীয় অঞ্চলের ছোট্ট দেশ কাতারের এত বড় একটি আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়া নিয়েই আসলে ছিল অনেক সংশয়৷ সে শুধু এ কারণে নয় যে ফুটবলীয় সামর্থ্যে দেশটি এর আগে কোনোদিনই বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়নি৷ এর একটা কারণ ছিল, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ আয়োজন আর দেখতে আসা লাখ লাখ দর্শকের চাপ কিভাবে সামাল দেবে মাত্র অর্ধকোটি জনসংখ্যা আর একটিমাত্র মহানগরের দেশ কাতার, তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা৷ দশ বছর আগে যখন এই বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়েছিল কাতার, তখন এখানে অবকাঠামো ছিল সামান্যই৷ প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলারের মহাযজ্ঞশেষে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সাফল্যের সঙ্গেই টুর্নামেন্টটার আয়োজন সুসম্পন্ন করে ফেলেছে তারা, ফাইনালের আগে একথা এখন বলাই যায়৷ সেই আয়োজনেও আছে অভিনবত্ব, টুর্নামেন্টের জন্য নতুন করে বানানো আটটি স্টেডিয়ামের মধ্যে অন্তত একটির কথা তো লেখা থাকতেই হবে ইতিহাসে৷ ৯৭৪টি পণ্যবাহী কনটেইনার দিয়ে তৈরি আস্ত একটা বহনযোগ্য স্টেডিয়ামে হচ্ছে বিশ্বকাপের ম্যাচ, এমন অদ্ভুতুড়ে কথা কেই বা কল্পনা করেছে!

তবে আয়োজনে যতই অভিনবত্ব থাক, খেলার মাঠে হোক যত অঘটন, সেই সবকিছু ছাপিয়ে এই বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত হয়ে থাকবে ফুটবলীয় বিচারে মহানায়কদের বিশ্বকাপ৷ সেই নায়কদের তালিকায় ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে সবার আগে লেখা থাকবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম৷ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক জুড়ে মাঠ আলো করে রাখা পর্তুগিজ সুপারস্টারের এটাই শেষ বিশ্বকাপ, জানা ছিল আগে থেকেই৷ তবে শেষটা যে এমন বেদনার হবে, কে জানতো! মরক্কোর কাছে শেষ আট থেকে পর্তুগালের বিদায়ের কারণেই শুধু নয়, এক সময়ের অপরিহার্য রোনালদো যে তার আগেই তাঁর নিজের দলের একাদশে অপাংক্তেয় হয়ে পড়বেন, এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না৷

এ কে এম খাদেমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
এ কে এম খাদেমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকছবি: Mohammad Rabbani

রোনালদোর সঙ্গেই গত দেড় দশক ধরে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই চলেছে যার, সেই লিওনেল মেসির জন্য আবার এই বিশ্বকাপটা যেন হয়ে উঠেছে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার মঞ্চ৷ প্রথম ম্যাচে সৌদিদের কাছে হার ভুলে তার দল যে এখন ফাইনালে! আর মাত্র একটা ম্যাচ, একটা জয়ের অপেক্ষা, তাহলেই সর্বকালের সেরা হয়ে ওঠার পথে শেষ হার্ডলটাও টপকে যাবেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার৷ টুর্নামেন্টটা যেপথে এগোচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন নিয়তিই তাকে নিয়ে যাচ্ছে সেই পথে৷ এখন পর্যন্ত খেলা সব কটি ম্যাচেই ম্যাচসেরা হয়েছেন তিনি; ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দ্বিতীয়বার টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার গোল্ডেন বল জেতা এখন সময়ের ব্যাপার৷ পাঁচ গোল নিয়ে গোলদাতাদের তালিকারও শীর্ষে আছেন তিনি৷ লক্ষ্যণীয় এই পাঁচ গোলের তিনটিই তিনি করেছেন পেনাল্টি থেকে৷  পোল্যান্ডের বিপক্ষেও একটি পেনাল্টি পেয়েছিলেন মেসি, সেটি থেকে গোল করতে পারলে তো এখন গোলদাতাদের তালিকারও সবার ওপরে থাকতেন তিনি৷

আপাতত সেখানে একজনের সঙ্গেই তার লড়াই৷ প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে তার সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপ্পে৷ চার বছর আগের বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় এমবাপ্পে এই বিশ্বকাপেও আলো ছড়াচ্ছেন একই দ্যূতিতে, প্রতিপক্ষের রক্ষণসীমানায় কাঁপুনি ধরাচ্ছেন মেসির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়৷ শেষ পর্যন্ত মেসিকে কাঁদিয়ে বিশ্বকাপের ট্রফিটা যদি এমবাপ্পের হাতেই উঠে যায়, অবাক হওয়ার থাকবে না কিছুই৷ লড়াইটা যে হচ্ছে রাজা আর রাজপুত্রের মধ্যে৷ একজন এখন পর্যন্ত সর্বকালের সেরা; আরেকজন এমন, যার সামনে রয়েছে ভবিষ্যতে তাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার হাতছানি!