সয়েস, গান হলো ত্রিশ বছর পর
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০কখনো কখনো দেশি লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান, চায়ের দোকানে আড্ডা দেন৷
জার্মান এই লোকটিকে কে পছন্দ না করবে৷ ডয়চে ভেলে থেকে বেরিয়ে সোজা ট্রেন ধরলাম৷ আমার মতো বকচক্ষুর মানুষেরও মাঝে মাঝে জায়গা চিনতে ভুল হয়৷ সেবারও হলো৷
জিগি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাদের কনসার্ট দেখতে৷ এই আহ্বান কে ঠেলে ফেলতে পারে! সময় মতো সেখানে যাওয়া হলো না৷ অনেক কষ্টে শিষ্টে পৌঁছলাম বেশ খানিকটা সময় বাদে৷ শহরের পৌর হলঘর ভাড়া করা হয়েছে৷ সেখানে যাবার পথে শুনলাম অন্ধকারে বয়ে যাওয়া একটি নদীর কলকাকলি৷ খলখল শব্দ৷ পাথুরে নদী৷
জিগি প্রথমে সেই ব্যান্ড দলে ছিলেন না৷ পরে যোগ দিয়েছেন৷ তা এই কথাটা আজকের নয়৷ ৩০ বছর আগের৷ দলের নাম সয়েস৷ এক গ্রিক দেবতার নামে নাম৷ জার্মানির ইসারলন শহরের লেটমার্ট এলাকায় যে মাধ্যমিক স্কুল, যাকে এখানকার ভাষায় বলা হয় গিমনাসিউম, সেখানেই গড়ে ওঠে সেই ব্যান্ড৷ তখন ছিলেন ইয়র্গ স্মিটস, রোনাল্ড পারট, ফ্রান্ক বুশ, আন্দ্রেয়াস মার্টিন, স্পীডি শেফার৷ পরে দলে যোগ দেন ফ্রাঙ্ক রসম্যান এবং টোমাস কাসলম্যান৷
রোনাল্ড পারট গাইতেন৷ ইয়র্গ গিটারিস্ট৷ বুশ রিদম গিটারিষ্ট এবং মার্টিন ছিলেন ড্রামার৷ বেসম্যান ছিলেন শেফার৷
সকলের একই উদ্দেশ্য৷ গান গাইবেন৷ উদ্দেশ্য অল্প দিনেই সফল৷ স্কুল ব্যান্ড হিসাবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তারা৷ প্রথমে অন্য গায়কদের গান গাইতেন৷ পরে আস্তে আস্তে নিজেরাই গান তৈরি করতে থাকেন৷ জিগি ওই স্কুলে পড়তেন না৷ কিন্তু গান লিখতেন ওদের জন্য৷
এভাবেই শুরু একটি ব্যান্ড দলের৷ লেটমার্ট ছাড়িয়ে এক সময় এই ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তা আশেপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে৷ ভালোই চলছিল বেশ কয়েক বছর৷ কিন্তু স্কুল শেষ হবার পর তো আর বসে থাকা যায় না৷ তাই নিজ নিজ কর্মস্থলে চলে যান সকলে৷ কেউ যোগ দেন সেনাবাহিনীতে৷ কেউবা ডাকসাইটে ব্যবসায়ী৷ কেউবা শিক্ষক৷ অবশ্য এদের কয়েকজন পেশা হিসাবে নেন সংগীতকেই৷ ফ্রাঙ্ক বুশ এদের মধ্যে অন্যতম৷ তাঁরা ছড়িয়ে যান জার্মানির বিভিন্ন স্থানে৷
এরপর এক দুই দিন করে ৩০ বছর৷ বছরে তাঁরা এক দুইবার বসতেন৷ আলাপ আলোচনা করতেন আবার এক সঙ্গে গান করার৷ কিন্তু সেই স্বপ্নটা অনেকটাই স্বপ্ন হয়ে থাকতো৷ কিন্তু গত বছরের গোড়ার দিকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলেন বছরের শেষার্ধে তাদের কনসার্টটি হবেই৷
সেই কনসার্ট দেখতেই আমার যাত্রা৷ সিটি হলের জায়গাটা ততক্ষণে ভরে গেছে ছোট্ট ছিমছাম ঐ শহরের মানুষের কোলাহলে৷ ভিতরে ঢুকতেই অবাক, কোন দেশের লোক নেই সেখানে! নানা দেশের লোক এসেছে৷ আমিও৷ একটি একটি করে গান হয়ে যাচ্ছে৷ গান বাজাবার মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো স্মৃতিমালা, দুষ্টুমি৷ রাত বাড়ছে, মানুষের উত্তেজনা বাড়ছে৷
সয়েস, ৩০ বছর আগের দল৷ কিন্তু তাদের গান শুনে মনে হচ্ছে, এখনো কতোটা তরুণ তারা৷ আমার আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়৷ চলে যেতে হবে৷ কিন্তু যেতে পারছি না৷ মাঝে মাঝে মানুষ চাইলেও অনেক কিছু পারে না, আমি আজ তেমনি, উঠতে পারছি না৷ আমি সুরের সমুদ্রে ঘুরছি৷
সব কিছুরই শেষ থাকে৷ এক সময় ৩০ বছর পরের এই মিলন মেলা ভাঙলো৷ গান শেষ হলো৷ এবার উঠতে হবে৷ আমি বের হবো, সামনে এসে উপস্থিত রোলান্ড৷
: কেমন লাগলো?
: ভালো৷ খুব ভালো৷ খুবই আনন্দ হয়েছে৷
: ধন্যবাদ৷
: আবার কবে হবে এমন মিলন মেলা?
: আবার হয়তো ৩০ বছর পর..
উত্তরটা দিয়েই হাসতে থাকলেন রোলান্ড৷ হাত মিলিয়ে বাইরে আসছি অনেকের সঙ্গে৷ সকলের মুখে একটি পরিতৃপ্তির ভাব৷ এদের অনেকেই সেই ৩০ বছর বাগে সয়েস এর গান শুনতেন৷ স্মৃতি রোমন্থন করছেন বেরিয়ে যাবার সময়ও৷
বাইরে হিমেল বাতাস বয়ে যাচ্ছে৷ সেপ্টেম্বর মাস৷ কোথা থেকে এক পশলা বৃষ্টি এসে আমাকে ভিজিয়ে দিল৷ মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ লাগে...
প্রতিবেদক: সাগর সরওয়ার
সম্পদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক