1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘‘সোনা যায়, সোনা আসে’’

রেশমী নন্দী
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

ক'দিন পরপরই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে সোনার অবৈধ চালান আটকের খবর পাওয়া যায়৷ আগের চেয়ে এ বিষয়ে সতর্কতা বাড়লেও আটকানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান৷

https://p.dw.com/p/2pQ8H
Gold Nuggets, Bonanza Gold Mine, Oregon
ছবি: picture-alliance/prisma

ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়তই বিদেশ থেকে আসছে সোনা৷ গত ২৯ নভেম্বরও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অবৈধ সোনা৷ অভিনব কায়দায় ট্রলি ব্যাগের বাইরের দিকে পেঁচানো ‘তারে' সোনা গলিয়ে ঢুকিয়ে আনার চেষ্টা করছিল ওই যাত্রী৷ এর আগে গত ১১ নভেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক যাত্রীর কাছ থেকে তিন কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সোনা জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা৷ এভাবে চোর পুলিশ খেলার মধ্যেই চলছে সোনার চোরাচালান৷ পাচারকারীরাও খুঁজে বের করছেন নিত্য নতুন অভিনব কোনো পথ৷

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসা এ সব সোনার বেশিরভাগই বিভিন্ন পথে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পাচার হয়৷ তবে অনেকের অভিযোগের তীর দেশীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দিকেও৷ ব্যবসায়ীরা অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা কিছু কিছু সোনা ক্ষেত্রবিশেষে কেনা হলেও বাংলাদেশের সোনার বাজারের চাহিদার বেশিরভাগ অংশই পূরণ হয় পুরোনো সোনা দিয়েই৷ বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, সোনার রিসাইক্লিং ও ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনার মাধ্যমেই দেশের সোনার চাহিদা অনেকটা পূরণ হয়৷ তিনি বলেন, সাধারণভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনার দাম আট থেকে নয়শ' টাকা বেশি থাকে৷ ফলে চোরাচালানকারীদের উদ্দেশ্য থাকে, ভারতে সোনা বিক্রি করে বেশি মুনাফা লাভ করা আর সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আদর্শ রুট৷

শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার

২০১৬-১৭ অর্থবছরের ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, বিদেশ থেকে একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার আনতে পারবেন৷ এ জন্য তাকে শুল্ক দিতে হবে না৷ আর সোনার বার আনতে পারবেন ২৩৪ গ্রাম, তবে এর জন্য শুল্ক দিতে হবে৷ তবে এই সোনাও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যই কেবল আনা যাবে৷

মূলত বিদেশ থেকে সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দর ব্যবহৃত হয়৷ গত দু'মাসে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় আড়াই কেজির মতো সোনার চালান আটক করা হয়৷ আটককৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা হয়েছে৷ তবে খুব বড় চালানের ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা দায়ের হলেও, ছোটখাট চালানের ক্ষেত্রে ধরা পড়ার পর শুল্ক পরিশোধ করে তা ছাড়িয়ে নেয়া যায়৷ ফলে অনেক যাত্রীর মধ্যে এ ছাড়ের কথা মাথায় রেখেই রুলসের বাইরেও সোনা আনার প্রবণতা দেখা যায়৷ শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার তানভির আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, নির্দিষ্ট সীমার থেকে অল্প কিছু বেশি সোনা আনা হলে সাধারণত তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় না৷ বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আনার সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে তারা এ ছাড় দেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরের ডিসি 

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গত চার বছরে বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে দুই হাজার কেজি সোনা উদ্ধার করেছে, যার বাজার মূল্য এক হাজার কোটি টাকারও বেশি৷ অন্যদিকে টিআইবি-র সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় স্বর্ণ সংশ্লিষ্ট এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি বাৎসরিক ৪৮৭ থেকে ৯৭৪ কোটি টাকা পর্যন্ত৷ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, সোনার অবৈধ প্রবেশ আগের তুলনায় অনেকটা কমানো সম্ভব হলেও বন্ধ করা যায়নি৷ প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালান অব্যাহত আছে৷ শুল্ক ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা তো থাকেই, এর সাথে অন্যান্য অপরাধও সংশ্লিষ্ট থাকে৷ মইনুল খান বলেন, সোনার যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক মূল্য রয়েছে, সেহেতু নানা অপরাধের সাথেই এই সোনার অবৈধ লেনদেন জড়িত রয়েছে৷

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান

গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ২০১৪ সালের পর থেকে সোনা চোরাচালান সংক্রান্ত ১৫ টি ফৌজদারি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে৷ স্বর্ণ চোরাচালান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরের ডিসি শেখ নাজমুল আলম বলেন, গোয়েন্দা তদন্তে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা দীর্ঘদিন ধরে সোনা চোরাচালানের সাথে জড়িত৷ তবে এখনো পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়েনি৷ ‘‘চোরাচালানকারীদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে৷ আমাদের কাছে খবর আছে, জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা আবারও এই ব্যবসা শুরু করেছে৷'' গোয়েন্দা তদন্তের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট অনেককে সোনা চোরাচালানে সহযোগিতা করার অভিযোগে আটক হয়েছে৷ নাজমুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতামতে, বিমানবন্দরে কেউ সহযোগিতা না করলে সোনা আনা অসম্ভব৷''

অন্যদিকে, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার তানভির আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লোকসংখ্যার সমস্যা না থাকলেও প্রযুক্তিগত কিছু কমতির কারণে সব ফ্লাইটের উপর একইভাবে নজরদারি সম্ভব হয় না৷ সাধারণত দুবাই থেকে আসা সব ফ্লাইটের উপর কড়া নজর রাখা হয়৷ অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বা সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে চেকিংয়ের আওতায় আনা হয়৷''

বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, গত চার বছরে সোনা চোরাচালানের সাথে জড়িত অন্তত ২০০ জনকে আটক করা হয়েছিল৷ এদের মধ্যে কয়েকজনকে বিচারের মুখোমুখি করা হলেও অনেকে জামিনে আছেন, অনেকে আবার আছেন আত্মগোপনে৷ কঠোর সাজা এবং বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে দেশে সোনার অবৈধ প্রবেশ অনেকাংশে ঠেকানো যাবে৷ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, বিমানবন্দরগুলোতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যে গুলোর বিষয়ে ইতিমধ্যেই সরকারকে অবহিত করা হয়েছে৷ তাঁর কথায়, ‘‘সক্ষমতার জায়গাটা আরো বাড়ানো উচিত৷ এ বিষয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছে যেমন ডগ স্কোয়াডের ব্যবস্থা রাখা, পর্যাপ্ত ও উন্নততর স্ক্যানারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি৷ এ সব দিকে নজর দেয়া গেলে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে৷''

তবে ব্যবসায়ীদের মতে, বাংলাদেশে স্বর্ণনীতি যতদিন না হবে ততদিন পর্যন্ত সোনা এ অবৈধ প্রবেশ বন্ধ করার সম্ভব হবে না৷ বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণনীতির কথা বলে আসছে ব্যবসায়ীরা৷ সম্প্রতি এ বিষয়ে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘সহজভাবে সোনা যাতে দেশে আনা যায়, সে ব্যবস্থা করা দরকার৷ নয়ত সোনা চোরাচালান কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না৷'' এ বিষয়ে সচিব পর্যায়ে কয়েকটি বৈঠক হয়েছে উল্লেখ করে গঙ্গাচরণ বলেন, সব পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করে নীতিমালা হলে চোরাচালানের সাথে জড়িত বলে দেশের স্বর্ণব্যবসায়ীদের দিকে যে আঙুল তোলা হয়, তা বন্ধ হবে৷

জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত প্রায় ১৮ হাজার জুয়েলার্স আছে৷

বন্ধু, প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷