1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সাংবাদিকদের উপর অদৃশ্য চাপ!

সমীর কুমার দে, ঢাকা১৩ অক্টোবর ২০১৫

আমার সাংবাদিকতার বয়স প্রায় ১৬ বছর৷ সবসময়ই যে স্বাধীনভাবে বা মনখুলে লেখার সুযোগ পেয়েছি, তা নয়৷ মাঝে মধ্যেই কাজের ক্ষেত্রে এক ধরনের চাপে পড়তে হয়েছে৷ বিশেষ করে ২০০৭ এবং ২০০৮ সাল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷

https://p.dw.com/p/1GnMf
Abdus Salam
ছবি: ETV

সেই সময়টা সরবরাহ করা নথি থেকে রিপোর্ট লিখে জমা দিতে হতো৷ অপরাধ বিভাগে কাজ করার সুবাদে ওই নথি আমাকেই সংগ্রহ করতে হতো৷ এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর, বহুদিন স্বাধীনভাবেই রিপোর্ট করার সুযোগ পেয়েছি৷ তবে সরকারের মন্ত্রী বা ‘বিশেষ' ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সব সময়ই সচেতন থাকতে হতো৷ কিন্তু কিছু দিন হলো হঠাৎ করেই কেমন যেন এক ধরনের অদৃশ্য চাপ অনুভব করছি৷ আমাকে কেউ রিপোর্ট করতে নিষেধ করেনি, রিপোর্ট লেখার কারণে কেউ আমাকে বকা দেয়নি, চাকরি হারানোর কোন শঙ্কাও তৈরি হয়নি৷ তারপরও কেমন যেন একটা অদৃশ্য চাপ ঘিরে ধরেছে আমায়৷ তবে এটা শুধু আমাকে নয়, বিভিন্ন পত্রিকার সহকর্মী বা টিভি চ্যানেলের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরাও একই কথা বলেছেন৷

আওয়ামী লীগ সরকারকে সব সময় মিডিয়ার বন্ধু হিসেবেই বিবেচনা করা হয়৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ‘মিডিয়া ফ্রেন্ডলি'৷ মাঝে মধ্যেই তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন৷ অনেক বড় বড় দেশের সরকার প্রধানরাও সরাসরি ‘প্রেস কনফারেন্সে' আসতে ভয় পান! আবার অনেক সরকার প্রধান মিডিয়া এড়িয়ে চলেন৷ কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন৷ একজন সাংবাদিক নেতাকে তো তিনি মিডিয়া উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগও দিয়েছেন, যাতে সরাসরি সাংবাদিকদের কথা তিনি জানতে পারেন বা শুনতে পারেন৷ এমন একজন প্রধানমন্ত্রীর সময়ে বিনা বিচারে সাংবাদিকদের কারাবাস চিন্তা করা তো সত্যিই কঠিন!

গত ৫ জানুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার হন একুশে টিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম৷ সেই থেকেই তিনি আটক৷ প্রথমে কারাগারে, আর এখন কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালে আছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে, হয়েছে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা৷ এর কোনো মামলাতেই অবশয চার্জশিট দেয়নি পুলিশ৷ অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো বিচার শুরু হয়নি৷ কিন্তু জামিনও পাচ্ছেন না আব্দুস সালাম৷ এটা তো এক ধরনের বিনা বিচারে কারাবাসের মতো! গত ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন তিনি৷ একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের সময় কেবেল অপারেটরদের দিয়ে একুশে টিভি দেখানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল৷ এখন কেবেল অপারেটররা সেটা ‘ওপেন' করে দিয়েছেন৷ সারা দেশে চ্যানেলটি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মালিক কারাগারে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ঠিকমতো চলছে না চ্যানেলটির কার্যক্রম৷

অথচ এই একুশে টেলিভিশনের অনুমতি দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তাঁর প্রথম শাসনামলে৷ প্রথম বেসরকার স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চ্যানেলটি৷ এরপর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়৷ দীর্ঘ আইনি যুদ্ধে পর নতুন করে সম্প্রচারে আসে একুশে টিভি৷ যতদূর জানি, প্রগতিশীল সাংবাদিকতার পক্ষেই তাদের অবস্থান৷ কখনও কখনও ভুল যে তারা করেনি, এমননি নয়৷ তারপরও তাদের কোনো ভুল থাকলে সংশোধনের সুযোগ দেয়া কি উচিত নয়? তাছাড়া ইটিভি-তে কাজ করেন অনেক পেশাদার সাংবাদিক৷ তাঁদের রুটি-রুজি নির্ভর করে চ্যানেলটির ভালোভাবে চলার উপর৷

বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার ধারা অনেকটাই পাল্টে গেছে৷ এখন এখানে যাঁরা কাজ করেন তাংদের অধিকাংশই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এসেছেন৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় তাঁদের দারুণ আগ্রহ৷ বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য খুঁজে বের করতে মনোযোগ বেশি তাঁদের৷ কিন্তু অদৃশ্য এক চাপের কারণে এ সব সাংবাদিকরা দৈনন্দিন রিপোর্ট করেই দিন শেষ করছেন৷ তারপর আবার মাথার উপর রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, যেটি বাতিলের জন্য আন্দোলন হলেও কোনো কাজ হয়নি৷ ফেসবুকে একটি ‘পোস্ট' দেয়ার কারণে কিছু দিন আগে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে৷ বিএনপি-জামায়াত আমলের নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করেন তিনি৷ আজ আওয়ামী লীগের শাসনামলেও তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছে৷ পঙ্গু হলেও জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷ হাতে লাগিয়েছে হাতকড়া! সাংবাদিক শওকত মাহমুদসহ অনেকেই আজ কারাগারে যেতে হয়েছে৷ যদিও সাংবাদিকতার বাইরে শওকত মাহমুদের মূল পরিচয় – তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা৷ তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হয়েছে৷

এখন আবার রাজনৈতিক কর্মীদের হাতেও চলে যাচ্ছে ‘অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড'৷ সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে সাংবাদিকদের অনুমতি দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন ‘আবিষ্কার' করে যে, বহু রাজনৈতিক কর্মীর হাতে রয়েছে এই ‘অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড'৷ বিভিন্ন অখ্যাত দৈনিক বা অনলাইনের নামে তাদের এই কার্ড দেয়া হয়৷‘অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড থাকলে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের অনুমতি দিতে অনেকটাই বাধ্য নির্বাচন কমিশন৷ ফলে জেনে বুঝেও নির্বাচন কমিশনকে ওই রাজনৈতিক কর্মীদের সাংবাদিকের কার্ড দিতে হয়েছে৷

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন নিয়ে কাজ করে ‘আর্টিকেল নাইনটিন' নামের একটি সংস্থা৷ গত ১লা মে প্রকাশ করা তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবহারকারী ও সাংবাদিকদের ওপর মোট ২১৩টি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে রয়েছেন ২০৫ জন সাংবাদিক ও আটজন ব্লগার৷ প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ সেগুলো হলো – চারজন সাংবাদিককে হত্যা, ৪০ জনের ওপর গুরুতর শারীরিক আক্রমণ এবং ৬২ জনের ওপর ছোটোখাটো হামলা৷ দেখা যায় হয়রানির মাত্রা ২০১৩ সালের চাইতে ১০৬ শতাংশ বেড়ে গেছে৷

Samir Kumar Day
সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলেছবি: privat

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৩ সালে যেখানে ৩৩ জন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, সেখানে ২০১৪ সালে সে সংক্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ জনে৷ এছাড়া গণমাধ্যমের সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিক সমিতির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাসহ ১৩ ব্যক্তিকে মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে আটজন এখনো কারাগারে রয়েছেন৷ নারী সাংবাদিকরাও কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হন৷

সব কিছু মিলিয়ে খুব একটা ভালো সময় পার করছেন না বাংলাদেশের সংবাদ কর্মীরা৷ কয়েকদিন আগে সংসদে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘মিডিয়া মনিটরিংয়ের জন্য আমাদের একটা টিম আছে৷ সংবাদপত্র স্বাধীন হলে মনিটরিং টিমের দরকার কেন? মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণারোপ করে কোনো সরকারই লাভবান হতে পারেনি৷ এক সময় এর বিস্ফোরণ ঘটেই! তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সরকারেরই৷''

সমীর কুমার দে’র সঙ্গে আপনি কি একমত? আপনার মতামত জানাতে পারেন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য