1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লোক ও কারুশিল্প বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতীক

সমীর কুমার দে
২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রতিটি জাতির একটা নিজস্ব স্বকীয়তা আছে৷ আর সেই স্বকীয়তা বোঝা যায় লোক ও কারুশিল্প দিয়ে৷ বোঝা যায় জাতিটি সংস্কৃতিতে কতটা এগিয়েছে, সেটাও৷ বললেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷

https://p.dw.com/p/2psIY
নকশি কাঁথা
ছবি: M. M. Rahman

‘‘বাঙালি জাতির আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য৷ জামদানি থেকে শুরু করে শীতল পাটি – বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে৷ তবে এখনও এমন অনেক কিছুই আছে যা স্বীকৃতি পেতে পারে৷ এর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷'' ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷ এই বিষয়েই জাপানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন জনাব মামুন৷

ডয়চে ভেলে: লোক ও কারুশিল্পের বর্তমান অবস্থাটা যদি সংক্ষেপে বলেন...

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্প আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ প্রতিটি জাতির গোষ্ঠী চরিত্র বহনকারী যে সমাজ থাকে, তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা, নান্দনিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক বোধ দিয়ে লোক ও কারুশিল্প সৃষ্টি করে৷ এই ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতিকে কোথাও কোথাও দেশজ সংস্কৃতি হিসেবে মানুষ চেনে৷ বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ৷ এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে৷ মসলিন থেকে শুরু করে, শীতল পাটি, বিয়ের পিঁড়ি, বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি শিল্প, এবং পোড়া মাটির শিল্প আমাদের ঐহিত্যের মূর্ত প্রতীক৷ বাংলাদেশকে যে আবহমান বাংলা বলা হয়, চিরায়ত বাংলা বলা হয়, সেটার একটা দৃশ্যমান নান্দনিকতা এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যাবে৷

লোক ও কারুশিল্পের কোন কোন ক্ষেত্রের আলাদা বিশেষত্ব আছে?

লোক ও কারুশিল্পের মধ্যে বিশেষত পোড়া মাটির হাড়ি অথবা বুননের ক্ষেত্রে যদি চিন্তা করেন শতরঞ্জি, জামদানি শাড়ি এবং বেত কেন্দ্রিক যে শীতল পাটি, তার একটা স্বকীয়তা আছে৷ কাঁসা-পিতলেরও খ্যাতি আছে৷ ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল থেকে শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা-পিতল বললেও আলাদা একটা স্বকীয়তা আছে৷ এছাড়া দেশ-জাতির যে আবেগের কথা বলা হয়, নকশিকাঁথাই সেটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়৷

লোক ও কারুশিল্পের মধ্যে কোনটি বেশি লোকজীবনে ব্যবহৃত হয়?

লোক ও কারুশিল্পের দু'টি দিকই মানুষের জীবনে প্রয়োজন বলে মানুষ এটা সৃষ্টি করেছে৷ তাঁরা তাঁদের ব্যক্তি জীবনে, ব্যবহারিক জীবনে বা নান্দনিকতার কারণে প্রাত্যহিক জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করেন৷ আপনি যদি আলপনার কথা বলেন, দেয়াল চিত্রের কথা বলেন, তাহলে হয়ত এগুলোর ব্যবহারিক উপযোগিতা সেভাবে নেই৷ কিন্তু মননের দিক থেকে, ভালোলাগার দিক থেকেও এগুলোর উপযোগিতা কম নয়৷ আর যদি সরাসরি ব্যবহারের কথা বলেন, তাহলে কারুশিল্পগুলো আমাদের ব্যবহারিক জীবনে অনেক বেশি কার্যকর এবং প্রয়োজনীয়৷

গ্রামের অনেক লোকশিল্প লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? সেগুলো চলমান করার ক্ষেত্রে কী করা উচিত?

‘দেশ-জাতির যে আবেগের কথা বলা হয়, নকশিকাঁথাই সেটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়’

কোনো দেশ বা জাতি যদি তার শেকড়ের কথা বলে বা সেই পরিচয় বহন করে, এমনকি জাতীয়তাবোধের পরিচয় বহন করতে চায়, তাহলে এগুলোর চর্চা খুবই জরুরি৷ মূলত এটি সংরক্ষণ, সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন৷ এক্ষেত্রে সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান মূল ভূমিকা পালন করতে পারে৷ এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে যদি এ বিষয়ে পঠন-পাঠন বাড়িয়ে দেয়া যায় এবং এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দক্ষ জনবল তৈরি করা যায়, তাহলে এর সংগ্রহ-সংরক্ষণ বৈজ্ঞানিকভাবে করা সম্ভব এবং এর বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব৷

লোকশিল্প কীভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়?

লোকশিল্প সংরক্ষণের কথা যদি বলেন তাহলে এগুলো সংগ্রহ করা হয় খুবই আবেগের সঙ্গে৷ যাঁরা সংগ্রহ করেন, তাঁরা সেটা করেন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে, ভালোলাগা থেকে৷ যদি সংরক্ষণের কথা বলেন, তাহলে আমি বলবো এখানে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে৷ আমি মনে করি, সোনারগাঁওয়ে যে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আছে, জাদুঘর আছে, সেখানে একভাবে সংরক্ষণ করা হয়, পাশাপাশি অনেকগুলো জাদুঘরেও লোক ও কারুশিল্প সংরক্ষণ করা হয়৷ এটা যদি আপনি বৈজ্ঞানিকভাবে করতে চান তাহলে প্রশিক্ষণ জরুরি৷ এ বিষয়ে আমার উত্তর, এর জন্য জ্ঞানলাভ করা জরুরি৷

সোনারগাঁওয়ের জাদুঘরের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কোনো সম্পর্ক আছে?

সোনারগাঁওয়ের জাদুঘরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঠিক সেভাবে নেই৷ আমরা যাঁরা নিজেদের আগ্রহ থেকে পরিদর্শনে যাই, খোঁজ নিতে যাই – সেটুকুই৷ আর জাদুঘর যদি কোনো আলোচনায় আমাদের ডাকে, তবে ঐটুকুই৷ এর পরিসর বাড়ানো যেতে পারে৷ আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে ‘ইন্টার্নশিপ' করতে পারে৷ যাঁরা ফোকলোর নিয়ে বা লোকজ শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করেন তাঁরা ওখানে গিয়ে এই ‘ইন্টার্নশিপ' করতে পারেন, গবেষণা করতে পারেন৷ যদি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সমন্বয় থাকত তাহলে লোক ও কারুশিল্পের বৈজ্ঞানিকভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো যেত৷

এই জাদুঘরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে পড়াশোনা করছেন, এমন শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্ক আছে কি?

আমি যতদূর মনে করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে বেড়াতে গেছেন, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক বা সমঝোতা এখনো তৈরি হয়নি৷ আমি মনে করি, আমাদের একটা চমৎকার সুযোগ আছে জাদুঘরটির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন তৈরি করার৷ শিক্ষার্থীরাও এই ফাউন্ডেশনে অবদান রাখতে পারবেন বলে আমি মনে করি৷

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বা জাদুঘরের সঙ্গে ফোকলোর একাডেমি বা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো আলোচনা আছে কি?

এই ফাউন্ডেশন বা জাদুঘরের যে সম্পদ, অবকাঠামো বা ব্যবস্থাপনা আছে – তা দেখে আমি সত্যিই বিমোহিত৷ এখানে ফোকলোর একাডেমি বা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা সম্ভব৷ এতে নতুন করে কোনো বরাদ্দ না-ও লাগতে পারে৷ শুধু নামকরণ ও কাজ শুরু করা গেলে আমাদের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্র তৈরির যে সীমাবদ্ধতা আছে তা অনেকখানি পূরণ করা যাবে৷

বাংলাদেশের এই শিল্প বিশ্বজুড়ে কতটা আলোচনায় আছে? কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার আছে কি?

বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প বিশ্বখ্যাত৷ বিশেষ করে আপনি যদি মসলিনের কথা বা জামদানির কথা অথবা শীতল পাটির কথা বলেন, তাহলে দেখবেন এর একটা আলাদা স্বকীয়তা আছে, পরিচিতি আছে৷ আপনি হয়ত শুনেছেন, খুব সম্প্রতি শীতল পাটি ও জামদানিকে সাংস্কৃতিক ঐহিত্য হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে৷ আমি মনে করি, ইউনেস্কো যখন এই স্বীকৃতি দেয় তখন এগুলোর মর্যাদা অনেকগুণ বেড়ে যায়৷ এমন অনেক আরো শিল্প আমাদের আছে, যেগুলো ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে ঢুকতে পারে৷ তাই আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷

শিল্প সংরক্ষণে সরকারিভাবে আর কি কিছু করার আছে?

সরকারের অনেক কিছু করার আছে৷ সরকার চাইলেই একটি লোকজ সাংস্কৃতিক অধিদপ্তর করতে পারে৷ চাইলে সরকার তার বাজেটের মধ্যে এর বিকাশে বরাদ্দ রাখতে পারে৷ চাইলে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে পারে৷ চাইলে আলাদাভাবে মনিটরিং বা নজরদারি করতে পারে৷ সরকার চাইলে আরো যেটা পারে, সেটা হলো দেশের কলেজগুলোতে বা পিএসসিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে লোকজ সংস্কৃতি বা ফোকলোর বিষয়ে যাঁদের জ্ঞান আছে তাঁদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে৷

এই শিল্প সংরক্ষণ ও বিকাশে আপনার পরামর্শ কী?

প্রায় ২০ বছর হলো, আমি ফোকলোর স্টাডিজ পড়ছি-পড়াচ্ছি৷ এতে করে মনে হচ্ছে এই বিষয়টির পঠন-পাঠন আরো জনপ্রিয় করা দরকার৷ মেধাবীদের এই পঠন-পাঠনে এগিয়ে আসা দরকার৷ এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফোকলোর-এর পঠন-পাঠন বাড়িয়ে দিতে পারে৷ স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে৷ যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ আর তা হলো, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলোর স্টাডিজ হিসেবে পৃথক একটি বিভাগ চালু করেছে৷ এরপর কবি নজরুল ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা চালু হয়েছে৷ এবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যদি চালু করা যায় তাহলে দক্ষ জনবল তৈরি হবে আর প্রয়োগিক দিকটাও আমরা কাজে লাগাতে পারব৷ আমি বলব, দেশকে ভালোবাসুন, আমাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসুন৷ লোকজ সংস্কৃতি আমাদের জাতীয়তাবোধের পরিচয় বহন করে, এটা আমাদের মানসিক শক্তি দেয়, এগিয়ে যাবার প্রেরণা দান করে৷

এই সাক্ষাৎকারটি নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান