1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা পরিভাষা-২

৮ নভেম্বর ২০১১

বাক্যে শব্দের অযথা সংস্কৃতায়নে রবীন্দ্রনাথের সম্মতি ছিলো না৷ ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থের ‘অনুবাদচর্চা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘ইংরেজি বাক্য বাংলায় তরজমা করিবার সময় অনেকেই সংস্কৃত শব্দের ঘটা করিয়া থাকেন৷’’

https://p.dw.com/p/136dj
ছবি: tagoreweb.in

কবিগুরু বলেন, ‘‘বাংলা ভাষাকে ফাঁকি দিবার এই একটা উপায়৷ কারণ, এই শব্দগুলির পর্দার আড়ালে বাংলা ভাষারীতির বিরুদ্ধাচরণ অনেকটা ঢাকা পড়ে৷''

সংস্কৃতায়িত অনেক পারিভাষিক শব্দই রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায়নি৷ বহুল ব্যবহৃত ‘গঠনমূলক' এবং ‘বাধ্যতামূলক' শব্দকে তিনি বলেছেন বর্বর শব্দ৷ ‘সহানুভূতি' শব্দটির প্রতিও রবীন্দ্রনাথ নিরতিশয় বিরক্ত ছিলেন৷ ‘অবলাবান্ধব' পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ইংরেজি 'সিম্প্যাথি' শব্দের বাংলা করেছিলেন ‘সহানুভূতি'৷ শব্দটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য – ‘‘সহানুভূতির ওপর আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই৷'' পরে তিনি তাঁর মন্তব্যকে আরো তীক্ষ্ণ করেছেন, বলেছেন, ‘‘সাহিত্যের হট্টগোলে এমন অনেক শব্দের আমদানি হয়, যা ভাষাকে চিরদিনই পীড়া দিতে থাকে৷ যেমন, সহানুভূতি৷'' রবীন্দ্রনাথ ‘সিম্প্যাথি'র প্রতিশব্দ করতে চেয়েছিলেন ‘অনুকম্পা'৷ তবে ‘দরদ' শব্দটির ওপর তাঁর চরম দুর্বলতা ছিলো৷

ইংরেজি ‘কালচার' শব্দের বাংলা করা হয়েছিলো ‘কৃষ্টি'৷ রবীন্দ্রনাথ শব্দটাকে একেবারেই সহ্য করতে পারেননি৷ বলেছেন, ‘‘কালচার শব্দের একটা নতুন বাংলা কথা হঠাৎ দেখা দিয়েছে; চোখে পড়েছে কি? কৃষ্টি৷ ইংরেজি শব্দটার আভিধানিক অর্থের বাধ্য অনুগত হয়ে ঐ কুশ্রী শব্দটাকে কি সহ্য করতেই হবে৷ এঁটেল পোকা পশুর গায়ে যেমন কামড়ে ধরে ভাষার গায়ে ওটাও তেমনি কামড়ে ধরেছে৷'' কালচার-এর বাংলা কি হবে তা নিয়ে তিনি বিস্তর গবেষণাও করেন৷ অবশেষে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘সংস্কৃতি' শব্দটির প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কালচার-এর প্রতিশব্দ হিসেবে 'সংস্কৃতি' শব্দ সম্বন্ধে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ অনুমোদন জ্ঞাপন করেন৷

Rabindranath Tagore Spuren in Kustia Flash-Galerie
বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে কবিগুরুর আবাসছবি: DW

পারিভাষিক শব্দ তৈরির বেলায় রবীন্দ্রনাথ ব্যাকরণের বেড়াজাল থেকে বের হতে গররাজি ছিলেন না৷ বঙ্গাব্দ ১৩৪১-এ লিখিত এক পত্রে তাঁর এই মনোভাব লক্ষ্য করা যায়, ‘‘ভাষায় সবসময় যোগ্যতমের নির্বাচননীতি খাটে না, অনেক সময়ে অনেক আকস্মিক কারণে অযোগ্য শব্দ টিকে যায়৷ সর্বপ্রধান কারণ হচ্ছে তাড়া – শেষ পর্যন্ত বিচার করবার সময় যখন পাওয়া যায় না তখন আপাতত কাজ সারার মতো শব্দগুলো চিরসত্ত্ব দখল করে বসে৷ আমার মনে হয় যথাসম্ভব সত্বর কাজ করা উচিত – কাজ চলতে চলতে ভাষা গড়ে উঠবে - তখন পারিভাষিক শব্দগুলি অনেক স্থলে প্রথার জোরেই ব্যাকরণ ডিঙিয়ে আপন অর্থ স্থির করে নেবে৷'

সংস্কৃতায়িত অনেক শব্দ সম্বন্ধে আপত্তি তুললেও পরিভাষা প্রণয়নে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপরই নির্ভর করেছিলেন বেশি৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ইংরেজিতে যে-সব শব্দ অত্যন্ত সহজ ও নিত্য প্রচলিত, দরকারের সময় তার প্রতিশব্দ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন তাড়াতাড়ি যা হয় একটা বানিয়ে নিতে হয়৷ সেটা অনেক সময় বেখাপ হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় মূল ভাবটা ব্যবহার করাই স্থগিত থাকে৷ অথচ সংস্কৃত ভাষায় হয়তো তার অবিকল বা অনুরূপ ভাবের শব্দ দুর্লভ নয়৷ একদিন ‘রিপোর্ট' কথাটার বাংলা করার প্রয়োজন হয়েছিল৷ সেটাকে বানাবার চেষ্টা করা গেল, কোনোটাই মনে লাগল না৷ হঠাৎ মনে পড়লো কাদম্বরীতে আছে ‘প্রতিবেদন' – আর ভাবনা রইল না প্রতিবেদন, প্রতিবেদিত, প্রতিবেদক যেমন করেই ব্যবহার করো কানে বা মনে কোথাও বাধে না৷''

Flash-Galerie Bangladeshi singer Dr. Sanjida Khatun
বিশ্বকবি’র জন্মের সার্ধশত বর্ষ উপলক্ষ্যে বহু অনুষ্ঠান হচ্ছে দুই বাংলাতেই...ছবি: DW

তিনি জানতেন, নতুন শব্দ বানাবার কাজে ‘‘সংস্কৃত ভাষার নৈপুণ্য অসাধারণ৷ ব্যবস্থাবন্ধনের নিয়মে তার মতো সতর্কতা দেখা যায় না৷'' তবে তিনি অন্য পণ্ডিতদের মতো একান্তভাবে সংস্কৃত নির্ভর ছিলেন না৷ মাঝে মধ্যে চলতি বাংলাও ব্যবহার করেছেন৷

‘বাংলা শব্দতত্ত্ব' গ্রন্থের বৈশাখ ১৩৯১-এ প্রকাশিত তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের বানানো ৯১৩ টি পারিভাষিক শব্দের তালিকা দেওয়া হয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘পারিভাষিক শব্দ পুরোনো জুতো বা পুরোনো ভৃত্যের মতো – ব্যবহার করতে করতে তার কাছ থেকে পুরো সেবা পাওয়া যায়৷'' রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো পারিভাষিক শব্দ এখনো বারবার ব্যবহৃত হচ্ছে, সবগুলো অবশ্য নয়৷ তবে বারবার ব্যবহৃত শব্দগুলির ব্যবহার হতেই থাকবে, কারণ শব্দগুলোর কোনো বিকল্প নেই৷

কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে৷ অপহরণ, আপতিক, অভিযোজন, অনীহা, অনুষঙ্গ, পটভূমিকা, আকাশবাণী, অনুষ্ঠান, অভিজ্ঞান-পত্র প্রতিলিপি, অপকর্ষ, আপজাত্য, প্রণোদন, দুর্মর, লোকগাথা, প্রাগ্রসর, অনুকার, প্রতিষ্ঠান, নঞর্থক, অনাবাসিক, অবেক্ষা, ঐচ্ছিক, ক্ষয়িষ্ণু, অনুজ্ঞা, রূপকল্প, সংরাগ, জনপ্রিয়, আবাসিক, প্রতিবেদন, একক সংগীত, যথাযথ, আঙ্গিক, প্রদোষ, মহাকাশ প্রভৃতি অতুজ্জ্বল শব্দ তাঁরই বানানো৷ এগুলো পারিভাষিক শব্দ হিসেবেই নির্বিকল্পভাবে ব্যবহৃত হয়৷

তাঁর বানানো শব্দ সর্বদাই যে, মূলানুগ হয়েছে তা নয়৷ এ ব্যাপারে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, এতে ‘‘সুবিধা এই যে, বারবার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দবিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে ওঠে, মূলে যেটা অসংগত অভ্যাসে তা সংগতি লাভ করে৷'' নতুন পরিভাষা তৈরি প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ইংরেজির অবিকল অনুবাদের প্রয়োজন কী?'' পরিভাষা প্রণয়ন করার সময় পণ্ডিতগণ এখনো এই কথাটা মনে রাখলে বাংলা পরিভাষার ভাণ্ডার দ্রুত ঋদ্ধ হবে৷

প্রতিবেদন: ফরহাদ খান
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান