মিস ইউ বাংলাদেশ!
১৭ ডিসেম্বর ২০১৩হ্যাঁ, ‘সত্যিকারের' বাংলাদেশ৷ কেউ কেউ ‘সত্যিকারের' শব্দটি দেখে অবাক হতে পারেন৷ দেশ তো দেশই, তা আবার সত্যিকারের কী? উত্তরটা সাদাত হোসাইনের সামহয়্যারইন ব্লগে লেখা পোস্টটি পড়লেই পেয়ে যাবেন৷ লেখার শিরোনাম ‘মিস ইউ বাংলাদেশ!'
প্রায় এক বছর ধরে কোন বাংলাদেশকে দেখছি আমরা? সারা বছরের কথা না হয় থাক, এই ডিসেম্বরে, যখন সব স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়, ৩-৪ বছরের শিশু থেকে ১৫-১৬ বছরের কিশোর-কিশোরী এবং তাদের পরিবারের সবার বছর শেষে একবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য মন থাকে অস্থির, কী অবস্থা তখন বাংলাদেশের!
সাদাত হোসাইন তাঁর স্কুল জীবনের সেই দিনগুলোর কথা মনে করেই এই বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে লিখেছেন, ‘মিস ইউ বাংলাদেশ'৷ সাদাত মনে করেন, যে বাংলাদেশে ডিসেম্বরে নানা কিংবা দাদা বাড়ি গিয়ে গ্রাম বাংলার প্রকৃতির আশ্রয়ে, গ্রামের সরল-সহজ মানুষগুলোর কাছে গিয়ে মন জুড়ানো যেতো সেটাই প্রকৃত বাংলাদেশ; ককটেল-হাতবোমা-গুলি-পোড়া গাড়ি-পোড়া মানুষের ধোঁয়া আর গন্ধে ছেয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশ নয়৷ প্রিয় পাঠক, আপনারও কি তাই মনে হয় না?
‘নানুবাড়ি যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে প্রস্তুতি শুরু করতেন আম্মা৷ প্রতিদিন আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান, 'তোর পরীক্ষা শেষ হইতে আর কয়দিন বাকি?' - ছোটবেলায় ডিসেম্বরে এমনটিই দেখেছেন সাদাত, কিন্তু এখন কোনো মা কি তাঁর সন্তানকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন?
সাদাত তাঁর স্কুল জীবনের গল্পে লিখেছেন কীভাবে ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ার সময় মা-বাবা তাদের দু ভাইকে নিয়ে নানা বাড়ি বেড়াতে যেতেন৷ যাবার আগে পরিবারের প্রতিটি মানুষের অধীর আগ্রহে দিন গোনা, মায়ের ‘বুকের ভেতর তৃষ্ণার পাখি ডানা ঝাপটায়, কতদিন বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখেন না!'- সাদাত তা লিখেছেন৷ নানুবাড়িতে অফুরন্ত স্বাধীনতা ; সেখানে নানুর হাতে হরেক রকমের ফল আর ফলের রস খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন তিনি৷
নানু, অর্থাৎ মায়ের মা-র বাড়িতে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হতো সাদাতদের৷ যা হয়, ছোট্ট শিশু সাদাত আর তাঁর ভাই তখন হাঁটতে চাইতেন না৷ মা পালা করে কখনো সাদাতকে, কখনো তাঁর ভাইকে কোলে নিতেন৷ মায়ের কষ্ট দেখে বাবা বলে উঠতেন,‘ওই যে দূরে একটা শালিক, দেখিতো আমার দুই আব্বুর মধ্যে কে আগে গিয়ে ওই শালিকটা ধরতে পারে?' শুরু হতো দু ভাইয়ের দৌড়ানো৷
কাছে পৌছাতে না পৌছাতেই শালিক হাওয়া৷ বাবা তখন দূরের ধবধবে সাদা কাশফুল দেখিয়ে বলতেন, ‘কে আগে ছুঁতে পারবে ওই কাশফুল?' সাদাত লিখেছেন, ‘আমরা আবার ছুটি৷ দুই পুচকা উসাইন বোল্ট... ভোরের আলোয় চকচকে মেঠো পথ৷ তার দুইধারে স্বপ্নের মতন আদিগন্ত হলুদ সর্ষে ফুল৷ গভীর নীল আকাশ৷ সেখানে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় সবুজ টিয়ে... টি... টি...৷' এমন দৃশ্য কি বাংলাদেশে এখন কল্পনা করা যায়? নীল আকাশে মিশছে ককটেল-হাতবোমা, গুলি, পোড়া যানবাহনের ধোঁয়া; সর্ষের হলুদ এখন অনেক ফ্যাকাশে, আকাশেও কি আর টিয়ে কিংবা শান্তির কপোত নির্ভয়ে ওড়ে?
নানা বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যেতো সবার৷ বাবা-মা দুই ছেলেকে নিয়ে নিঃসঙ্কোচে চলে যেতেন রাস্তার পাশের কোনো কুঁড়ে ঘরে৷ পানি চাইলে কুঁড়ে ঘরের হতদরিদ্র পরিবারের বঁধূ অচেনা অতিথিদের জামবাটি ভরে গুঁড়-মুড়িও খেতে দিতেন৷
কোথায় সেই বাংলাদেশ? এখন রাজনীতির নামে মিছিল করে এসে নিরীহ মানুষের বাড়িতে দেয়া হয় আগুন৷ মানুষ মরে প্রতিদিন৷ হিংস্রতা, বর্বরতা থামাতে নামাতে হয় সশস্ত্র বাহিনী৷ মৃতের সংখ্যা বাড়ে৷ শান্তিপ্রিয় মানুষ আজ বড় অসহায়৷ সব মানবিক অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে ধোঁয়ার পর্দা আর ককটেল-হাতবোমা কিংবা গুলির শব্দে ঢাকা পড়ছে৷
সাদাত হোসাইন তাই তাঁর চিরচেনা বাংলাদেশের কথা ভেবে লিখেছেন,
‘‘মিস ইউ বাংলাদেশ!
সত্যিকারের বাংলাদেশ৷
সেই মাটি আর মানুষের বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশ...
মিস ইউ...''
সংকলন : আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা : জাহিদুল হক