মানবাধিকার বঞ্চিতদের কান্না, স্বাধীন তদন্ত কমিশনের দাবি
১০ ডিসেম্বর ২০১৪
যশোরের মালোপড়ার কান্না বুধবার ঢাকাতেও শোনা গেল৷ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে ঢাকায় এসে মালোপাড়ার বিশ্বজিত্ বিশ্বাস জানালেন তাঁদের ওপর হামলা এবং নির্যাতনের করুণ কাহিনি৷ তবে এখানেই শেষ নয়৷ নির্বাচনের প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও তাঁরা এখনো নিরাপদ নন৷ ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ একটাও পূরণ হয়নি৷ পুলিশ আসামি ধরে৷ ১০-১২ দিন পরে আসামির জামিন হয়ে যায় যায়৷ আমরা এখনো চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি৷''
‘মানবাধিকার হরণ: এ কী পরিস্থিতিতে দেশ' শিরোনামে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে নির্যাতিতদের কথা শোনার এই আয়োজন করে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি৷ সেখানে আরো অনেক মানবাধিকার বঞ্চিতরা কথা বলেন৷ ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান তাঁদের নির্মম কাহিনি৷
২০০০ সালের ২৩শে অক্টোবর সেনাবাহিনী ও এলাকাবাসীর মধ্যে সংঘর্ষের সময় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মো. রফিকের ছেলে জামাল নিহত হন৷ অনুষ্ঠানে রফিক বলেন, ‘‘আমি সব সময় গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকি৷ আজ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছি৷ বাড়িতে ফিরে আমার কী পরিস্থিতি হবে, তা ভাবতেও পারি না৷''
এক বছর আগে তানজিনা আক্তারের স্বামী মাহবুব হাসানকে ধরে নিয়ে যায় ডিবি পরিচয় দেয়া লোকজন৷ মাহবুব ছিলেন ঢাকার সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের নেতা৷ মাহবুব হাসানের স্ত্রী জানান, ‘‘দুই সন্তান নিয়ে আমাদের দিনগুলো কীভাবে কাটছে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না৷''
অন্যদিকে রাজধানীর মিরপুর বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা শহিদ আলী বাহাদুর অভিযোগ করেন, ‘‘ক্যাম্প দখল করার জন্য নয়জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ কয়েক দিন আগে একজনকে পিটিয়ে মেরেছে পুলিশ৷ এর এক মাস আগে চাঁদা দাবি করে না পেয়ে জাবেদ নামের একজনকে হত্যা করা হয়েছে৷ প্রতিনিয়ত আমাদের ক্যাম্প দখলের চেষ্টা হচ্ছে৷''
এরকম আরো অনেকের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কহিনি শোনান অনুষ্ঠানে আসা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী এবং সাধারণ মানুষ৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট বছরের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ন'মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে৷ এ সময়ে দেশে ৮২ ব্যক্তি গুম-অপহরণের শিকার হন৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে এসব ব্যক্তিকে তুলে নেয়া হয়েছে বলে তাঁদের স্বজনদের অভিযোগ৷ পরে ২৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে৷ ১০ জন ফিরে এসেছেন৷ সাতজনকে আটকের খবর স্বীকার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ তিনজনকে পরে থানায় ও কারাগারে পাওয়া গেছে৷ বাকি ৩৯ জন এখনো নিখোঁজ৷
২০১১ সালে গুম-অপহরণ হন ৫৯ জন৷ তাঁদের মধ্যে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার হলেও ৩৯ জন এখনো নিখোঁজ৷ ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৬ এবং ৩৪ জন এখনো নিখোঁজ৷ ২০১৩ সালে গুমের শিকার হন ৭৬ জন৷ তাদের মধ্যে ২৩ জনের লাশ পরে পাওয়া গেছে৷ অন্যরা এখনো নিখোঁজ৷
আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘ক্রসফায়ার', ‘বন্দুকযুদ্ধ' বা ‘এনকাউন্টারের' ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দু'হাজারেরও বেশি৷ চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে মারা গেছেন ১৩৬ জন৷ এ সব মৃত্যুর ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে মনে করে আসক৷
প্রেসক্লাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে বিচার বিভাগীয় দুটি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী এবং মানবাধিকার নেতা ড. শাহদীন মালিক৷ তিনি বলেন, ‘‘গুম-খুন-অপহরণের ঘটনায় একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিশন এবং আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য আরেকটি কমিশন করতে হবে৷''
আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারির আগেই এই কমিশন দুটি গঠন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ তদন্তের দাবি জানান শাহদীন মালিক৷
সংবাদিক এবং কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘‘ক্রসফয়ারে পেছনে রয়েছে দেশের সংঘাতময় রাজনীতি৷''
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘এ দেশের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার হরণের ঘটনা ঘটেছে ৫ই জানুয়ারি৷ ঐ দিন দেশের বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে৷''
এঁরা সকলেই মনে করেন, দেশ যদি সংঘাতময় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্রের পথে হাঁটে তাহলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ আর বন্ধ করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন৷ তা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে৷