1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিবাংলাদেশ

বেনজীরের সম্পদ: প্রশ্রয় দিয়েছে কে?

সাংবাদিক
মাসুদ কামাল
৫ এপ্রিল ২০২৪

"আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় বেনজীর সাহেবকে বিচারের আওতায় নেওয়া হবে?”

https://p.dw.com/p/4eTYT
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এবং  ব়্য়াবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ
বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক হওয়ার আগে ব়্য়াবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেনজীর আহমেদছবি: bdnews24.com

সরাসরি এমন প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। কী জবাব দেব? জবাব দেওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে বরং পাল্টা প্রশ্ন করলাম, "আপনার কী মনে হয়?”

তিনি যেন উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেয়ে কিছুটা খুশিই হলেন। কিছুমাত্র চিন্তা না করেই বললেন, "কিচ্ছু হবে না। দেখবেন, কিছুই হবে না তার। মামলা টামলাও কিছু হবে না। বসুন্ধরা গ্রুপের পত্রিকায় এখন লেখালেখি হচ্ছে, কদিনের মধ্যে সব মিটমাট হয়ে যাবে। এরকম অনেক দেখেছি।”

ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বেশ সেন্সিবল মানুষ। দেশ, জাতি সম্পর্কে খবরাখবর রাখেন। এরকম একজন মানুষ যখন অবলীলায় এমন মন্তব্য করেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তখন কিছুটা হতাশ হতেই হয়।

বেনজীর সাহেব পুলিশের আইজিপি ছিলেন। পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে ছিলেন র‌্যাবের ডিজি। তারও আগে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো সময় ধরেই তিনি পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। টানা এতগুলো বছর দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে তার সুনাম ও দুর্নাম দুই-ই হয়েছে। তবে দুর্নামের পরিমাণ হয়তো কিছুটা বেশি ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, বেনজীর আহমেদ যখন পুলিশের আইজি'র দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্র তখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাব এবং এর ছয় কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন জারি করে। র‌্যাবের যে সময়ের কর্মকাণ্ডের কারণে এই স্যাংশন আসে, সেই পুরো সময়জুড়েই তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী

ছিলেন বেনজীর আহমেদ। ফলে স্যাংশন ঘোষণার সময় তিনি পুলিশের আইজি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও র‌্যাবের সাবেক ডিজি হিসাবে তার নামও সেই স্যাংশন তালিকার মধ্যে ছিল। সন্দেহ নেই তার এই ‘অর্জন' র‌্যাব এবং পুরো বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে সম্মানিত করেনি।

মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, র‌্যাবের ডিজি, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল—গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলোতে ধারাবাহিকভাবে থাকাকালীন তার ক্ষমতার দাপট, নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চটকদার কথাবার্তা, আর সেই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে উচ্চারিত হওয়া নানাবিধ স্ক্যান্ডালের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত ছিলেন। অনেকেই অনেক কিছু জানতেন, কিন্তু প্রকাশ্যে উচ্চারণের হয়তো সাহস পেতেন না। তার অবসরগ্রহণের দুই বছর পর সেই প্রকাশ্য উচ্চারণটাই এখন হচ্ছে।

গত ৩১ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় বেনজীর সম্পর্কিত রিপোর্টগুলো যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, দেখে শুরুতে আমি কিছুটা বিস্মিতই হয়েছি। এ বিস্ময় দুধরণের। প্রথমত, আরও অনেক সরকারি কর্মকর্তার মতো তার বিপুল সম্পদের বিষয়গুলো তো প্রকাশিতই। সম্পদগুলো যেখানে, সেখানকার লোকজন তো বটেই, এর বাইরেও অনেকেই জানত। অনেক দিন ধরেই জানত। কিন্তু সেগুলো যে মিডিয়াতে এভাবে খোলামেলাভাবে প্রকাশিত হবে কখনো, এটাই ছিল বিস্ময়ের বিষয়। দ্বিতীয়ত, পত্রিকাটি কালের কণ্ঠ-ই কেন? কালের কণ্ঠ বসুন্ধরা গ্রুপের পত্রিকা। এই বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে একসময় বেনজীর সাহেবের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। বসুন্ধরার এমডি ও পুলিশের আইজি'র ঘনিষ্ঠ ছবিও বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে। তাহলে এর মধ্যে কী এমন হলো যে, একজনের বিরুদ্ধে অপরজনকে এরকম জেহাদ ঘোষণা করতে হবে?

কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় সেদিন বেনজীরের দুর্নীতি বিষয়ক বেশ কয়েকটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। রিপোর্টগুলোর বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, ট্রিটমেন্ট—ইত্যাদি দেখে মনে হয়েছে এসব কেবল সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের প্রতিফলনই নয়। এসবের পিছনে নিশ্চয়ই মালিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বড় কোনো বিষয় রয়েছে। পত্রিকার মালিকে মালিকে লড়াই এ ভূখন্ডে নতুন কিছু নয়, এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখা গেছে। আমি নিজে একসময় দৈনিক জনকণ্ঠে চাকরি করতাম। তখন দেখেছি প্রথমে ইনকিলাব ও পরে যুগান্তরের সঙ্গে জনকণ্ঠের লড়াই। সেই বিরোধগুলো কিন্তু পত্রিকার আদর্শ নিয়ে ছিল না, ছিল মূলত দুই পত্রিকার মালিকের স্বার্থ নিয়ে। আবার কালের কণ্ঠ যখন প্রথম প্রকাশিত হলো, শুরুতে দেখা গেছে প্রথম আলো পত্রিকা, তার সম্পাদক বা মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে নানা রিপোর্ট করতে। এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ যখন বাংলাদেশ প্রতিদিন নামে আরও একটা বাংলা পত্রিকা বের করল, সেটাকেও যেন শুরু থেকেই দেখা গেল প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অনেকটা জেহাদ ঘোষণা করতে। এবার, বেশ কিছুদিন ধরে বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়াগুলোকে দেখা যাচ্ছে রংধনু গ্রুপের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে। বসুন্ধরার মতো রংধনু গ্রুপও একই ধরনের ব্যবসায়, প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্টের বাণিজ্য করে। একসময় তারা পরস্পরের সহযোগী ছিল। কিন্তু স্বার্থের দ্বন্দ্বে এখন রীতিমত দা-কুমড়া সম্পর্ক। রংধনু গ্রুপ আবার কিছুদিন হলো মিডিয়া ব্যবসায় নেমেছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ নামে একটা দৈনিক পত্রিকা, গ্রীণ টিভি নামে একটা টেলিভিশনও আছে তাদের। সম্পর্ক মন্দ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই গ্রুপই যার যার মিডিয়াগুলোতে প্রতিপক্ষকে নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রচারণাও চালাচ্ছে গত বেশ কিছুদিন ধরে। বেনজীর আহমেদ যখন আইজিপি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন থেকেই তিনি রংধনু গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন বলে প্রচারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন বসুন্ধরা ও রংধনু গ্রুপের বহুল চর্চিত সেই দ্বন্দ্বেরই চরম প্রকাশ হচ্ছে এই ৩১ মার্চের রিপোর্ট। বসুন্ধরা গ্রুপ হয়তো মনে করেছে, বেনজীরের মাধ্যমেই রংধনু গ্রুপ সরকার ও প্রশাসনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন পাচ্ছে। তাই তারা রণকৌশল হিসাবে আক্রমণের লক্ষ্য করেছে বেনজীর আহমেদকেই।

দুই ব্যবসায়িক গ্রুপের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হলেও এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে নগ্ন হয়ে গেছে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণির কুৎসিত চেহারাটা। কালের কণ্ঠ কেন, কী কারণে এই সময়ে এমন একটা রিপোর্ট করেছে, তা নিয়ে হাজারো গবেষণা হতে পারে। অনেকে ষড়যন্ত্র বা সন্দেহও প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তাতে গোপালগঞ্জে ১৪০০ বিঘা জমির ওপর সাভানা রিসোর্টের অস্তিত্ব তো আর হাওয়া হয়ে যাবে না। কিংবা স্ত্রী, কন্যাদের নামে পূর্বাচলের সম্পত্তি, গুলশানের রাজকীয় আবাসস্থল, গাজীপুরে রিসোর্ট, বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার—এসবকে তো আর বায়বীয় বলা যাবে না। একজন সরকারি চাকরিজীবী, যার মাসিক বেতন এক লাখ টাকাও নয়, সে কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের এত সম্পদের মালিক হলেন? এমন প্রশ্নের জবাব তো দেশের মানুষ চাইতেই পারে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, অতি জরুরি এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? বেনজীর আহমেদকে এ প্রশ্নের জবাব অতি অবশ্যই দিতে হবে। ৩১ মার্চ রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর, এ নিয়ে সাবেক এই আইজিপি এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অশুদ্ধ বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে যে স্ট্যাটাস তিনি দিয়েছেন, তাতে কোনো কিছুই স্পষ্ট হয়নি। বরং সেটাকে কিছুটা আধ্যাত্মিক টাইপ মনে হয়েছে। আবার তিনি যদি বলেন, এই স্ট্যাটাসটা ওই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়নি, সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি—এটাই ধরে নিচ্ছি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি নিরব থাকছেন? তার এই নিরবতা কি অপরাধ স্বীকারেরই নামান্তর নয়? কিছু বলার নেই, তাই বলছেন না। নাকি হাতে নাতে ধরা খেয়ে গেছেন, তাই চুপচাপ আছেন? নয়তো এলোমেলো শব্দাবলীর মাধ্যমে দার্শনিক টাইপ অস্পষ্ট কথাবার্তা বলছেন। এসব সম্ভাবনার যে কোনটা, অথবা সবকটিই সত্য হতে পারে।

এখন কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা এক জীবনে কিভাবে হাজার কোটি টাকা অর্জন করতে পারে? টাকাগুলো যে বৈধ নয়, সেটা উপলব্ধির জন্য রকেট সায়েন্স অধ্যায়নের দরকার পড়ে না। বৈধ হলে সেগুলো তিনি তার স্ত্রী আর কন্যাদের নামে করতেন না। নিজে বাঁচার জন্য বলতে গেলে তিনি তার স্ত্রী-কন্যাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টার যদি কখনো সুবিচার হয়, যদি অপরাধ প্রমাণ হয়, ওনার পাশাপাশি এই তিন নারীর নামের সঙ্গেও কিন্তু দুর্নীতির কলঙ্কটি লেগে যাবে। লোভ দ্বারা মানুষ কতটা পরিচালিত হলে অতি প্রিয় স্ত্রী-কন্যাদের মান-সম্মান নিয়ে জুয়া খেলতে পারে!

যে কথাটা বলছিলাম, কিভাবে সম্ভব এক জীবনে এত বিপুল দুর্নীতি করা? আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি সরকারি কর্মকর্তাদের এত বড় বড় দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়? নাকি, কর্মকর্তারাই বেপরোয়া আচরণের মাধ্যমে এসব করে থাকে? সম্ভবত এক্ষেত্রে পরের অপশনটাই কাজ করেছে। আইজিপি তো বেনজীর আহমেদই প্রথম বা একমাত্র ছিলেন না। আরও অনেকেই ছিলেন। এই মাপের দুর্নীতির কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। হয়তো অনেকে করেছেন, কিন্তু এভাবে প্রকাশিত হয়নি। হয়তো এখনো অনেকে করছেন। কে জানে তারা যখন অবসরে যাবেন তাদের গুলোও প্রকাশিত হবে, অথবা হবে না।

লেখাটা শেষ করি বরং শুরুর প্রসঙ্গটা দিয়ে। আমার পরিচিত সেই অধ্যাপক সাহেব বলেছিলেন, ‘‘কিছুই হবে না।'' এত দৃঢ়ভাবে তার অমন উচ্চারণ কি একেবারে অমূলক? তা নয় বোধকরি। এদেশে আসলে সরকার সংশ্লিষ্টদের কিছু হয় না। সরকার তো আসলে ভিন্ন কিছু নয়, এদের নিয়েই সরকার। সরকার নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করে, এরা তাদের পুরো প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেই অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডকে সহযোগিতা করে। আর বিনিময়ে সরকার তাদেরকে সুযোগ দেয় দুর্নীতি করার। এভাবেই তো চলছে দেশ। বেআইনীভাবে এক বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারের খবর আমরা পড়েছি। জেনেছি মন্ত্রীর বিদেশে থাকা হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির কথা গোপন করার কথা। একাধিক এমপির বিদেশে বাড়ি-সম্পদ আছে—তার তথ্য প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে, কোনো জবাবদিহিতা দেখিনি। গোয়েন্দা সংস্থা, দুদক, সরকার, বিচার বিভাগ—কেউ কিছু বলেনি। এসব দেখে দেখে আমাদের চোখ সয়ে গেছে। এসব হতে দেওয়া বা মেনে নেওয়া যে সরকারের জন্য বিব্রতকর বা লজ্জার—সেটা বোধকরি সরকার নিজেও মনে করে না।

কে যেন একজন বলেছিল, ‘আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন যে—আপনি লজ্জা পাবেন না, তাহলে কেউই আপনাকে লজ্জা দিতে পারবে না।' আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বোধকরি সেরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য