বিবাহিত হিন্দু নারীদের ভোট দেয়া কঠিন হবে?
২৩ মার্চ ২০১৮গত সোমবার (১৯ মার্চ) নির্বাচন কমিশন (ইসি)-র সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বিয়ের পর নারীরা চাইলেই জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করে তাঁদের নামের সঙ্গে স্বামীর নামের অংশ বা পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না৷ শিক্ষা সনদ অনুযায়ী যে নাম, তাই বহাল থাকবে৷ তবে বিশেষ প্রয়োজনে কেউ চাইলে এবং যাঁদের শিক্ষা সনদ নেই, তাঁরা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করবেন৷ আর কমিশন তা যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেবে৷ শিক্ষা সনদ যাঁদের নেই তাঁদের বাবা-মা যে নাম রেখেছেন, সেটিই গ্রহণ করা হবে৷
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, মিতা সরকার নামের একজন নারী তাঁর নামের পদবি পরিবর্তনের আবেদন করেন ইসিতে৷ তাঁর স্বামীর নাম রাজীব সিংহ রায়৷ মিতা নামের সঙ্গে স্বামীর গোত্র পদবি সিংহ রায় নিতে নাম পরিবর্তন করে মিতা সিংহ রায় করতে চান৷ জাতীয় পরিচয়পত্রে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মিতা সরকার স্নাতক পাস৷ তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ শিক্ষা সনদের পক্ষে মতামত দেয়৷
তাতে বলা হয়, ‘‘হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা বিয়ের পর স্বামীর পদবি ধারণ করেন৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের নামের সংশোধনী চেয়ে অনেক আবেদন আসে৷ তাঁরা তাদের সন্তানের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদে বা জন্ম নিবন্ধনে বাবা-মায়ের নাম পদবিসহ উল্লেখ করেন৷ এমন পরিস্থিতিতে মায়ের শিক্ষাসনদে বাবার/স্বামীর পদবি না থাকা সত্ত্বেও স্বামী বা বাবার পদবি দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করা হবে কিনা, এ বিষয়ে একটি সার্বজনীন সিদ্ধান্ত প্রয়োজন৷ শিক্ষা সনদে স্বামীর পদবি না থাকায় যদি জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন না হয়, তাহলে সন্তানদের শিক্ষা সনদ অনেক সময় অকার্যকর হয়ে যায়৷ জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়েও সমস্যা তৈরি হয়৷ আবার শিক্ষা সনদ থাকলে নাম বা অন্যান্য ক্ষেত্রে শিক্ষা সনদের সঙ্গে মিল না করে সংশোধন হবে কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন৷’’
ওই মতামতের ভিত্তিতে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ‘‘কমপক্ষে এসএসসি শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ থাকলে ওই সনদ অনুযায়ীই কেবল এনআইডি সংশোধন করা যাবে৷ তাছাড়া যাঁদের সনদ নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র নিয়ে দরখাস্ত করলে বিবেচনা করবে কমিশন৷’’ আর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইসি শিক্ষাসনদ অনুযায়ী মিতার নাম সংশোধনের নির্দেশনা দেয়৷
ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলাল উদ্দীন আহমদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘সনদে যে নাম, সে নামে পরিচয়পত্র করার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ যাঁদের সনদ নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে মা-বাবা যে নাম রেখেছেন, সেটি হবে৷ কেউ স্বামীর নাম যুক্ত করতে চাইলে ইসিতে দরখাস্ত করতে হবে৷ প্রতিটি আবেদন আলাদাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইসি সিদ্ধান্ত দেবে৷’’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ইসি'র এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন তিন কারণে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মেয়েরা বিয়ের আগে পিতার গোত্র এবং বিয়ের পরে স্বামীর গোত্র নামের সঙ্গে যুক্ত করে৷ এটা ধর্মীয় নিয়ম৷ এর ব্যতিক্রম করা হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে৷ হিন্দু নারী কুমারী না বিবাহিত তা-ও নির্ধারণ হয় নামের শেষে গোত্র দেখে৷ বিয়ের পরও কোনো হিন্দু নারী যদি পিতার গোত্র ব্যবহার করে, তাহলে তাকে বিধবা ভাবা হতে পারে৷ বিবাহিত যে হিন্দু নারীরা এরইমধ্যে স্বামীর গোত্র ধারণ করে এনআইডি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং পাসপোর্ট করেছে, তারা ব্যাপক সংকটে পড়বে৷ আর এই কারণে অনেক নারী স্বামীর গোত্র বাদ দিয়ে শিক্ষাসনদ অনুযায়ী এনআইডি করে ভোট দেয়ার চেয়ে ভোট না দেয়ায় স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের মাত্র সাত মাস আগে ইসি'র এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মতো সক্ষমতা নেই৷ আর যদি তা কার্যকর করতে যায় তাহলে আমার মনে হয় শতকরা ৯০ ভাগ বিবাহিত হিন্দু নারী ভোট দিতে পারবেন না৷’’
অন্যদিকে নারী নেত্রী এবং জাতীয় মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়টি বাধ্যবাধকতার হতে পারে না৷ কোনো নারী বিয়ের পর তাঁর স্বামীর পদবী ব্যবহার করতেও পারেন৷ আবার না-ও করতে পারেন৷ তবে ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা পার্সপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের জন্য শিক্ষাসনদের নামই অনুসরণ করা উচিত বলে আমি মনে করি৷ কারণ, নামের ক্ষেত্রে প্রামাণ্য কিছু তো থাকতে হবে৷ শিক্ষা সনদের নামকেই আমি সঠিক বলে মনে করি৷ তবে শিক্ষা সনদের নামও তো পরিবর্তন করা যায়৷ ভুল সংশোধন করা যায়৷ তাই যৌক্তিক সংশোধন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘হিন্দু ধর্মের কথা আলাদা৷ কিন্তু মুসলমানদের তো ডিভোর্স ব্যবস্থা আছে৷ তাহলে যতবার ডিভোর্স হবে, একজন নারী ততবার তাঁর এনআইডিতে নাম পরিবর্তন করবে? আর মুসলমানদের মধ্যে পদবি ব্যবহারের বিষযটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার নয়৷’’
তবে এলিনা খান বলেন, ‘‘ইসি যেটাকে বাধ্যতামূলক করতে চায়, সেটাকে আমি ঐচ্ছিক করার পক্ষে৷’’