বিদেশি অনুদান আইন নিয়ে উদ্বেগ, সরকারের আশ্বাস
১৮ অক্টোবর ২০১৬অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, কোনোভাবেই এ আইনের অপব্যবহার করা হবে না৷ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের একটা সুরক্ষা থাকা দরকার৷
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু এমপি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই আইন নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই। এই আইনের ফলে বিদেশী অনুদান কোনভাবেই বাধাগ্রস্থ হবে না। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য এটা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে সংসদকে টিআইবি বলেছে, পুতুল নাচের ঘর, এটা কি শোভন কোনো বক্তব্য? তারা তো এটা বলতে পারে না। রাষ্ট্রের জন্য জিও-এনজিও সবার ভুমিকা আছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রের উন্নতি হতে পারে। আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, এটার কোনোভাবেই অপপ্রয়োগ হবে না। এই আইনের যখন বিধি তৈরি করব, তখন পুরো বিষয়টি ব্যাখা করা হবে।''
টিআইবির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দু'দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে হোসে কার্লোস উগাস বলেন, ‘‘এ আইনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষিত হয়নি। এতে দুর্নীতিবিরোধী কাজ ব্যাহত হবে।'' দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খুব খারাপ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। হোসে বলেন, ‘‘বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনটি ইতিমধ্যে পাস হয়ে গেছে এবং রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত অনুমোদনের অপোয় আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইনের মাধ্যমে টিআই দুর্নীতিবিরোধী কাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে।''
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘নাগরিক সমাজ কীভাবে কাজ করে, তার একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে। আমি মনে করি, আইনের কারণে নাগরিক সমাজের কথা বলার সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে।'' নাগরিকদের কথা বলার স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয় এমন কিছু সরকার করবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। টিআই চেয়ারপারসন আরো বলেন, ‘‘আমরা সরকারের শত্রু নই। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের শত্রু। দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই।''
বিদেশি অনুদান রেগুলেশন আইন ২০১৬-এর ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘কোনো বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তি সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক বা অশালীন বক্তব্য দিলে বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে এনজিও ব্যুরো সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে।''
চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের ব্যাপারে ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্নীতি প্রতিরোধ-সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে আমরা সরকারের সঙ্গেও কাজ করছি। আমাদের চেয়ারম্যান যেটা বলতে চেয়েছেন, এনজিওগুলোর কাজের একটা আন্তর্জাতিক মানদন্ড আছে। আমরা সেটাই মেনে চলি। পাশাপাশি এমন কোনো আইন করা যাবে না, যেটা সংবিধানের পরিপন্থি। একটা বক্তব্য একজনের কাছে রাষ্ট্রবিরোধী মনে হতে পারে, আবার অন্যজনের কাছে সেটা না-ও হতে পারে। এর একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আমরাও প্রত্যাশা করি, সরকার এই বিষয়গুলো বুঝতে পারবে।''
ওই সাংবাদিক সম্মেলনে ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী সংবিধান এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ‘বিদ্বেষমূলক ও অশালীন' কোনো মন্তব্য করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে, সেটাকে বিদ্বেষমূলক হিসেবে আখ্যায়িত করে এই আইনের অপব্যবহার হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। তাই এটি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা-সংক্রান্ত সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।
এদিকে বিদ্বেষমূলক বা রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নিবন্ধন বাতিলের বিধান রেখে সংসদে পাস হওয়া আইনের বিরোধিতার সমালোচনা করেছেন আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছেন, ‘‘ গণমাধ্যমের যে অধিকার আছে, এনজিওর সেটা নেই। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন নাগরিকের জন্য। এনজিও এখানে অনেক ইনফিরিওয়র।’‘ মঙ্গলবার সংসদের মিডিয়া সেন্টারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একথা বলেন ।
সুরঞ্জিত বলেন, ‘‘‘একটা সার্বভৌম সংসদকে তো কোনো ফরেন বডি গালি দিতে পারে না। তাহলে সার্বভৌমত্ব থাকে না। পৃথিবীর কোথাও এটা নেই। কাজ করতে হলে এই আইনের অধীনে করতে হবে।’‘ গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে প্রবীণ এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘‘ গণমাধ্যমকে সংবিধানের অধীনে একটা আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তোমরা (গণমাধ্যম) বলতে পার। তোমাদের মানবাধিকারের প্রটেকশন আছে। কোনো ফরেন বডির তো সেটা নেই। একজন নাগরিক মত প্রকাশ করে অনেক কথা বলবে। সেটা তার অধিকার। এনজিও আইনের অধীনে কাজ করবে।’’
হোসে কার্লোস উগাস বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এবং টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, নাগরিক সমাজের সদস্য ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
প্রতিবেদন:সমীর কুমার দে, ঢাকা
সম্পাদনা:আশীষ চক্রবর্ত্তী