বছর শেষে কী দিলেন নরেন্দ্র মোদী?
২ জানুয়ারি ২০১৭বিদায়ী বছরের শেষ সন্ধ্যেতে, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে সাতটায় টিভিতে ভারতবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ দেশের মানুষ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় ছিলেন, এবার কী চমক দেন প্রধানমন্ত্রী৷ ৮ নভেম্বর আচমকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের ঘোষণার পর এত রকম নতুন নিয়মবিধি চালু হয়েছে এবং রদ হয়েছে, যে লোকে নাজেহাল৷ এই পরিস্থিতিতে সবারই প্রত্যাশা ছিল, নতুন বছরের উপহার হিসেবে হয়ত কোনও ভালো খবর দেবেন মোদী৷ হয়ত রেহাই মিলবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার ওপর জারি রাখা বিধিনিষেধ থেকে৷ হয়ত বাজারে যথেষ্ট পরিমাণ নতুন নোট পাওয়া যাবে নতুন বছরে৷
কিন্তু না, সেরকম কিছুই করলেন না প্রধানমন্ত্রী মোদী৷ তার বদলে সহজে ব্যাঙ্ক ঋণ পাওয়ার কিছু ঘোষণা করলেন, যা প্রত্যক্ষভাবে মানুষের কষ্ট লাঘবে কোনও ভূমিকাই নেবে না৷ একবার দেখে নেওয়া যাক, ঠিক কী কী ঘোষণা করলেন তিনি, বর্ষশেষের সান্ধ্যভাষণে৷
- শহরাঞ্চলে ৯ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণের সুদে ৪% এবং ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণের সুদে ৩% ছাড়৷
- ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাঙ্ক ঋণে গ্যারান্টার থাকবে কেন্দ্র সরকার৷ ডিজিটাল লেনদেন করলে ৬% কর ছাড় পাবেন ছোট ব্যবসায়ীরা৷
- কৃষকদের জন্য রবিশস্য ও খরিফ শস্যের মরশুমে ঋণশোধে ৬০ দিন পর্যন্ত রেহাই৷ কৃষকদের ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করতে তিন কোটি ‘কিষাণ কার্ড' বদলে যাবে ‘রু-পে' কার্ডে৷
- প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরে ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মেয়াদি জমার ক্ষেত্রে আগামী ১০ বছর ৮% সুদের নিশ্চয়তা৷
- দেশের ৬৫০ জেলায় গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবকালীন সুবিধা হিসেবে ৬০০০ টাকা কেন্দ্রীয় অনুদান৷
এর মধ্যে একদম শেষের যে ঘোষণাটি, অর্থাৎ মহিলাদের প্রসবকালীন অনুদান, সেটাই একমাত্র জনকল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরে নেওয়া যায়৷ যদিও ১২৫ কোটি মানুষের দেশে সন্তানজন্মে উৎসাহ দেওয়া কতটা বিচক্ষণতার পরিচয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়৷ যেমন প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ১০ বছরের মেয়াদি জমায় সুদের হার বৃদ্ধি কতটা আদতে প্রবীণদের স্বার্থে, সে প্রশ্ন তুলছেন লগ্নি বিশেষজ্ঞরা,কারণ, প্রবীণ মানুষদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি জমা আদৌ বাস্তবিক নয়৷ বরং চিকিৎসা ও অন্যান্য নিয়মিত প্রয়োজনে বরং স্বল্পমেয়াদি সঞ্চয়ই তাঁদের জন্য বেশি সুবিধার৷ কিন্তু বাদবাকি ছাড় ঘোষণার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট ধরন কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এবং সেটা বেশ স্পষ্ট৷ সরকার মূলত চাইছে, মানুষ আরও বেশি করে ধার নিক ব্যাঙ্ক থেকে৷ সে বাড়ি, বা গাড়ি কেনার জন্যেই হোক, বা ব্যবসার প্রসারে কিংবা কৃষিকাজে৷ সরকার নানা ছাড় ঘোষণার মাধ্যমে ঋণ নিতে উৎসাহ দিচ্ছে লোককে৷
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন? উত্তরটা খুঁজতে হলে একটু পিছনদিকে তাকাতে হবে৷ ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন বড় অঙ্কের নোট বাতিলের ঘোষণা করলেন, তখন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক উপদেষ্টা ডঃ কৌশিক বসু, হার্ভার্ডখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং থেকে শুরু করে বহু অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ একটাই প্রশ্ন করেছিলেন – ভারতে কী এমন জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে নোট বাতিল করার মতো একটা বড় সিদ্ধান্ত এমন আচমকা নিতে হলো? সাধারণ লোকের মনেও একই প্রশ্ন ছিল, কারণ, নোট বাতিল পরবর্তী সময়ে, টাকার আকালে, ব্যাঙ্ক আর এ টি এম-এর লম্বা লাইনে, নিত্যদিনের দুর্ভোগে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছিল যে সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি ছিল না৷ নেহাতই অপরিণামর্শী এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল এই নোট বাতিল৷
একটা সম্ভাব্য উত্তর উঠে এসেছিল সেই সময়৷ যে বহু লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের কারণে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলির নাভিশ্বাস উঠছে৷ মূলত বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলি বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে এবং শোধ দেয়নি৷ তার মধ্যে আছে বিজয় মালিয়ার মতো মহা শিল্পোদ্যোগী, যে বহু কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ রেখে দেশ ছেড়েই ফেরার হয়েছে! এদের অনৈতিকতার ভার চেপেছে ব্যাঙ্কগুলির ঘাড়ে৷ কাজেই ব্যাঙ্কগুলিতে আর্থিক মজুত বাড়ানোর আশু প্রয়োজন ছিল, ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে৷ এই প্রসঙ্গেই জানা যায়, বিখ্যাত মার্কিন সংস্থা ‘মুডি'র একটি রিপোর্টের কথা৷ বিশ্বজুড়ে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, এমনকি বিভিন্ন দেশেরও ‘ক্রেডিট রেটিং', অর্থাৎ ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা নিরপেক্ষভাবে নির্দিষ্ট করে দেয় পেশাদার সংস্থা মুডি৷ নরেন্দ্র মোদীর সরকার গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মুডি'র কাছে আর্জি জানিয়েছিল ভারতের ক্রেডিট রেটিং কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু সব খতিয়ে দেখে মুডি সেই আর্জি নাকচ রে দেয় মূলত দুটি কারণে৷ এক, ভারতের বিপুল পরিমাণ পুরনো বৈদেশিক ঋণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার কাছে, যা ভারত এখনও শোধ করতে পারেনি৷আর দুই, ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির আরও বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ, যা পরিশোধের কোনও সম্ভাবনাই আর নেই৷
এরকম বেহাল আর্থিক পরিস্থিতিতে, বড় অঙ্কের নোট বাতিল করে, বাজারে থাকা নগদ টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিতে বাধ্য করে, সেই টাকা তোলার ওপর দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ব্যাঙ্কের তহবিল ভরানো ছাড়া সরকারের কীই বা করার ছিল৷ আফসোস একটাই, যে সরকারকে তার জন্যে নানাবিধ ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হলো৷ কালো টাকা সাফ করার অজুহাত দিতে হলো, যদিও, আর্থিক হিসেব অনুযায়ী কালো টাকার মাত্র ৬% নগদ হিসেবে বাজারে থাকে৷ বাকি ৯৪% লগ্নি হয়ে যায় সোনায়, জমিতে, সম্পত্তিতে এবং সুইস ব্যাঙ্কের বেনামি আমানতে৷ ফলে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভরে নেওয়া হলো ব্যাঙ্কের তহবিল৷ এবার সেই টাকা নিয়ে বসে থাকলে তো ব্যাঙ্কের চলে না৷ তাকে সেই টাকা খাটাতে হবে৷ কীভাবে? মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে ঋণ দিয়ে৷ যাঁদের ঋণশোধ না করে বিজয় মালিয়াদের মতো দেশ ছেড়ে পালানোর সামর্থ নেই৷ অথবা বড় শিল্পগোষ্ঠীর মতো সরকারি দাক্ষিণ্যে ঋণ মকুব করিয়ে নেওয়ার জোর নেই৷ তাঁদের সুদের টাকাতেই আবার স্বচ্ছলতা আসবে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায়৷
এরপর বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেন ঋণ নিতে উৎসাহ দিচ্ছেন!