1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিল্প, না বিদ্যুৎ বিক্রি?

১৯ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশে আরো বেশি বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ৷ যা উসকে দিয়েছে নতুন বিতর্ক৷ পশ্চিমবঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে অচলাবস্থার জন্যই কি উদ্বৃত্ত থাকছে বিদ্যুৎ? বিদ্যুৎ বিক্রি করে কি যথেষ্ট আয় হবে ঋণগ্রস্ত রাজ্যটির?

https://p.dw.com/p/2r9I1
ছবি: Ravi Mishra/Global Witness

প্রশ্ন হলো, অর্ধেক গ্লাস জলকে ঠিক কীভাবে দেখা হবে? অর্ধেক ভর্তি, না অর্ধেক খালি? পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের বিষয়টিকে ঠিক এভাবেই দেখেন রাজ্যের অনেকে৷ কেউ বিষয়টিকে অহংকার এবং গর্বের বলে মনে করেন৷ কেউ আবার মনে করেন, শিল্পক্ষেত্রে অচলাবস্থাই আসলে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের কারণ৷

খবর, পশ্চিমবঙ্গ পরিকল্পনা করেছে, তাদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে৷ এ নিয়ে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দরবার করেছে৷ বস্তুত, এখনও বাংলাদেশে প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করে পশ্চিমবঙ্গ৷ সম্প্রতি এক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আরও ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে এ বিষয়ে আর্জি জানিয়েছি আমরা৷ সব ঠিকঠাক চললে, দ্রুতই বাংলাদেশের কাছে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করা যাবে৷''

পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে মোট পাঁচটি কার্যকরী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে৷ কোলাঘাট, বক্রেশ্বর, ব্যান্ডেল, সাগরদিঘি এবং সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে সব মিলিয়ে প্রায় ছ'হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়৷ এছাড়াও বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্র আছে৷ নিন্দকদের অভিযোগ, যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও পশ্চিমবঙ্গে সেই বিদ্যুৎ খরচ করার উপায় নেই৷ কারণ, শিল্পক্ষেত্রে দেশের বাকি অংশের তুলনায় এখনো অনেকটাই পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ৷ বাম আমলে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মোটেই কোনো উন্নতি হয়নি৷ মমতার সরকার বারংবার বড় শিল্প আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যক্ষেত্রে তা সফল হয়নি৷ ফলে বিদ্যুৎ খরচ করার মতো পরিসরই তৈরি হয়নি৷

বাকি রাজ্যগুলোর ছবি কিন্তু অন্যরকম৷ সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত তো নয়-ই, বরং ঘাটতি রয়েছে৷ ঘাটতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১ শতাংশের মতো৷ উত্তরপ্রদেশের মতো শিল্পবান্ধব রাজ্যে ঘাটতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৪ দশমিক ১ শতাংশের মতো৷ বড় শহরগুলির দিকে যদি চোখ রাখা যায়, দেখা যাবে, রাজধানী শহর দিল্লিতেও বাৎসরিক বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ০ দশমিক ৫ শতাংশ৷ সময় সময় তা আরও বৃদ্ধি পায়৷

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ছবিটি একেবারেই অন্যরকম৷ এবং সে কারণেই পার্শ্ববর্তী দেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ৷ এ বিষয়ে ডয়চে ভেলের তরফ থেকে তৃণমূলের প্রবীণ নেতা নির্বেদ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘যদি সত্যিই এমন সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে স্বাগত জানানো উচিত৷ এরফলে একদিকে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক মুনাফা হবে, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যটিরও উপকার হবে৷ বাংলাদেশ শুধু আমাদের প্রতিবেশী নয়, বৃহত্তর বঙ্গের অংশ৷ তাদের সঙ্গে বরাবরই আমাদের সম্পর্ক ভালো৷ এই পদক্ষেপ আরও একটি মাইলফলক হবে৷'' তবে রাজনৈতিক প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি৷ পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে তিনি রাজি হননি৷

সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য এবং সাংসদ মহম্মদ সেলিম স্বভাবতই কঠোর সমালোচনা করেছেন বিষয়টির৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘একসময় বলা হতো পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ নেই বলে কারখানা হচ্ছে না৷ দীর্ঘদিন ধরে বামফ্রন্ট রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে৷ এবং সেই বিদ্যুৎ থেকে যাতে নতুন কারখানা তৈরি করা যায়, তার চেষ্টাও করেছিল৷ কিন্তু বর্তমান সরকার শিল্প নিয়ে যে কোনো নীতিই গ্রহণ করতে পারেনি, এটাই তার প্রমাণ৷ বলা হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা নাকি শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে৷ আসলে যে হচ্ছে না, বিদ্যুৎ বিক্রির পরিকল্পনাই তার প্রমাণ৷ এর ফলে রাজ্যের আরও ক্ষতি হবে৷''

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছর বেঙ্গল সামিটে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল বলে জানিয়েছিল রাজ্য সরকার৷ তার আগের বছরের হিসেব ছিল ২ লক্ষ ৫০ হাজার৷ এ বছর বেঙ্গল সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী জানান, গতবছরের বিনিয়োগের ৫০ শতাংশের কাজ চলছে৷ কিন্তু সমালোচকরা বলেন, কোথায় চলছে, কীভাবে চলছে, কারা বিনিয়োগ করছে, তার কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়৷ পশ্চিমবঙ্গে ২ লক্ষ ৫০ কোটি টাকা শিল্পখাতে বিনিয়োগ হলে রাজ্যের চেহারাই বদলে যেতো৷ যেমন বদলানোর কথা ছিল সিঙ্গুরে ১০০০ একর জমির ওপর টাটার কারখানা তৈরি হলে কিংবা ৪০০০ একর জমির ওপর জিন্দালদের সম্পূর্ণ কারখানা তৈরি হলে৷ কিন্তু বাস্তবে টাটা'রা ফিরে গেছে৷ জিন্দালদের কারখানাও সেভাবে গড়ে ওঠেনি৷ একটি ছোট সিমেন্ট কারখানা তৈরি হয়েছে মাত্র৷সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগের কথা রাজ্য সরকার বলছে, বাস্তবে তার কোনো চিহ্ন এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি৷ এবং সত্যিই যদি সেই বিনিয়োগ হতো তাহলে ১২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারত না রাজ্য সরকার৷ প্রমাণস্বরূপ তাঁরা দেশের অন্যান্য শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্যগুলির উদাহরণ দিচ্ছেন৷ প্রভূত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও সেই রাজ্যগুলোতে শিল্পের কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে৷ উত্তরপ্রদেশ যার অন্যতম উদাহরণ৷

কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ইন্দ্রজিৎ রায় অবশ্য বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করছেন৷ তাঁর মতে, বিদ্যুৎ তৈরি করে তা বিক্রি করে রাজ্য সরকার আর্থিক মুনাফার কথা ভাবতেই পারে৷ যদিও অন্য রাষ্ট্রকে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের শিলমোহর দরকার৷ অর্থাৎ, বিষয়টি কেবলমাত্র আর রাজ্যের হাতে থাকে না, কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ বিষয় হয়ে যায়৷ তবে বিক্রির আগে বুঝে নেওয়া দরকার, পশ্চিমবঙ্গের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ সাময়িক নাকি, দীর্ঘমেয়াদী৷ সাময়িক হলে বাংলাদেশের সঙ্গে এত বড় কমিটমেন্টে গেলে ভুল হবে৷ আর যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়, তাহলে বুঝতে হবে আগামী বহুদিনের মধ্যে বড় শিল্পের কোনো পরিকল্পনা নেই পশ্চিমবঙ্গের৷ রাজ্যের মন্ত্রীদের কথা শুনলে তা মনে হয় না৷ ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মুখের কথা নয়৷ এত বিদ্যুৎ দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ সত্যিই দিতে পারবে কি না, তা বুঝে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি৷

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্তের মতে, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ একটি ঋণগ্রস্ত রাজ্য৷ গত কয়েক দশকে বিপুল পরিমাণ ধার জমেছে৷ ফলে বিদ্যুৎ বিক্রি করে যদি কিছু অর্থ ঢোকে কোষাগারে, তাতে অন্যায়ের কিছু নেই৷ কিন্তু এ ঘটনা প্রমাণ করে, অদূর ভবিষ্যতে এ রাজ্যে শিল্পের কোনো সম্ভাবনা নেই৷ সরকার তা বুঝে গিয়েছে৷ সে জন্যই বিকল্প মুনাফার ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা চলছে৷ যদি তা-ই হয়, তাহলে রাজ্যের মানুষকে স্বপ্ন দেখানো হয় কেন? সাম্প্রতিকতম শিল্প বিষয়ক বেঙ্গল সামিটে সরকার ঘোষণা করেছে, রাজ্যে নাকি ১ দশমিক ৯ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে৷ সত্যিই যদি তা আসতো, তাহলে বিদ্যুৎ বিক্রির কথা কল্পনাও করা যেতো না৷ উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ শিল্পখাতে প্রয়োজন হতো৷'' দীপঙ্কর দাশগুপ্তের মতে, বাম আমলের শেষ পর্যায়ে রাজ্যে শিল্প তৈরির কিছু প্রয়াস দেখা গিয়েছিল৷ কিন্তু বর্তমান সরকার শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই৷ বিদ্যুৎ বিক্রি করা তাই একরকম লজ্জার দৃষ্টান্তই বটে৷

রাজ্য সরকার ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য অর্ধেক পূর্ণ গ্লাসের দিকেই তাকাতে চাইছেন৷ তাঁরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প৷ একসময় পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল৷ ক্রমশ সেই ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়েছে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ এখন ভারতের অন্যতম রাজ্য৷ প্রতিবেশী দেশকে সেই বিদ্যুৎ বিক্রি করা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷

বিতর্ক ছিল, আছে, থাকবে৷ এখন দেখার, পশ্চিমবঙ্গ শেষপর্যন্ত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে বিক্রি করার ছাড়পত্র পায় কিনা৷ সবই এখন নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির উপর৷