তুমি যে তুমিই ওগো সেই তব ঋণ....
৯ মে ২০১০ঠাকুরবাড়ির খিড়কি পুকুর
ছিল৷ পুরানো ঠাকুরবাড়িতে এক নিবিড় খিড়কি পুকুর৷ কোমলকান্ত গাছের সবুজ ছায়ায় ঢাকা৷ দুপুরে তার নিস্তরঙ্গ জলের দিকে তাকিয়ে থাকত এক স্কুলছুট বালক৷ নিচতলার ভাঁড়ারে বুড়ি অমৃত দাসী পাথরের জাঁতায় সোনামুগের ডাল ভাঙে, আর তার শাদা কাপড়ে লেগে থাকে সোনার গুঁড়ো যেন বা৷ অবন ঠাকুর পরে সেই অমৃত দাসীর একখানি ছবিও এঁকেছিলেন৷ গরমের দিনে সাঁঝ নামতেই ফিরিওলা হাঁক দিয়ে যায় পথে, মা লা ই ই.. ব রো ফ ফ.. আর গো ও লা আ প ফু উ উ ল...৷ কিংবা দোলের দিনে দেউড়ির বিহারি দরোয়ানদের দোলখেলা, আর নতুন বৌঠানের হাতে বোনা কবি বিহারীলালের জন্য আসনটি দেখে কিশোর রবির বুকে চাপা ঈর্ষা৷ নতুন বৌঠানের কাছে কবি স্বীকৃতি পেতেই তো ভানুসিংহের পদাবলী! ব্রজবুলি ভাষায় যেন চন্ডীদাস বা বিদ্যাপতির সমসাময়িক সুললিত ছন্দে মাত্র ঊনিশ বছরে রবির লেখা ‘গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে/ মৃদুল মধুর বংশী বাজে’...কিংবা ‘শুনল শুনল বালিকা/ গাঁথ কুসুম মালিকা...৷’ তরুণী কাদম্বরী দেবী যখন প্রাচীন পদকর্তার রচনায় চমকিত, পুলকিত, তখন আসল নামটি ফাঁস করে দিয়ে সে কি আমোদ! আর দুলে দুলে হাসি! কিংবা সদর স্ট্রিটের বাড়ির ভোরবেলায় সূর্যোদয়ের মুহূর্তে ব্রহ্মান্ডের সঙ্গে সংযোগের আনন্দঘন মুহূর্তটি৷ যে মুহূর্ত জন্ম দিয়ে গেল..‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের পর/কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান....না জানি কেন রে এতদিন পরে/ জাগিয়া উঠিল প্রাণ...’
শুন নলিনী খুল গো আঁখি..
মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথমবার বিলেত যাত্রার আগে বোম্বাইতে একমাস৷ বসবাস শহরের শেরিফ তড়খড়ের বাড়িতে৷ ডাবলিনে পড়াশোনা করে আসা তাঁর কন্যা আন্নার কাছে বিলিতি আদবকায়দার পাঠ৷ ইংরেজি শেখা৷ বিনিময়ে তন্বী তরুণী আন্না শিখে নিচ্ছে বাংলা৷ সুহাসিনী, কলস্বনা নদীর মত মেয়েটির হাসিমুখ দেখতে রচনা করতে হচ্ছে নতুন নতুন গান৷ শেষ কৈশোরের রবি সে মেয়ের নাম দিলেন নলিনী৷ এক আলোকিত ভোরবেলায় ভৈরবী রাগে তাকে গেয়ে শোনালেন, ‘শুন নলিনী খুল গো আঁখি../ ঘুম এখনও ভাঙিল নাকি../ দেখ তোমার দুয়ার পরে সখী../ এসেছে নূতন রবি...৷' আন্নার জবাব, ‘কবি, তোমার গান শুনলে আমি মরণদিন থেকে প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি৷'
নন্দিনী অমিত আর বঙ্গভঙ্গ
এভাবেই চলতে চলতে একদিন শেষের কবিতায় অমিত রায়, একদিন রক্তকরবীর নন্দিনী আর বিশু পাগল, একদিন রবিবারের অভীক, কখনো বা নাস্তিক গোরার পালাবদল, চারুলতা আর অমলের অনুচ্চারিত প্রেম কিংবা ঘরে বাইরের বিমলার উঁকিঝুঁকি৷ তারই মাঝে ডাক আসে উত্তাল বঙ্গভঙ্গের৷ সম্প্রীতির রাখিবন্ধন করে সেই ভাঙনকে রুখে দেন সূর্যের মত দীপ্ত এক পুরুষ৷ দেশ যে কোন ভৌগলিক সীমানা নয়, দেশ যে পরাধীন জাতির আত্মায় বসবাস করে, দেশের মূক মুখ যে মানুষেরই অপমান! একথা পরাধীন জাতিকে নিজের গান দিয়েই চিনিয়ে দিলেন তিনি৷ বললেন ‘ও আমার দেশের মাটি/ তোমার পরে ঠেকাই মাথা....' বা গাইলেন তিনি...‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক/ জগতজনের হৃদয় জুড়াক...
সেই শৈশব থেকেই তাঁর হাতটি ধরা
আমার একজন নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ আছেন৷ বড় চেনা, বড় পরিচিত সেই মানুষটি৷ লম্বা জোব্বা, শাদা চুল, শাদা দাড়ি, একটু ন্যুব্জ হয়ে তিনি হাঁটেন, বড়ো চেনা তাঁর স্বর, তিনি বড়ো কাছের৷ ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে জেগে উঠলে, ব্যথা পেলে, আনন্দ হলে একছুট্টে চলে যাওয়া যায় তাঁর কাছে৷ সব কথা বলে হাল্কা হওয়া যায়৷ বোঝা যায়, তিনি ওই শিশু ভোলানাথের মত আপনভোলা কেউ৷ আবার শিলাইদহের বোটে এই মানুষটিই খুঁজে চলেন লালনকে৷ দেখা হয় না দুজনের৷ কিন্তু একই ভাষায় লিখে ফেলেন, ‘..আমারে কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই আপনারে....৷' পদ্মাপারে আর এক কবি গেয়ে যান, ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে / আমার ঘরের কাছে আরশিনগর/ সেথায় পড়শি বসত করে/ একখান পড়শি বসত করে....'
দোলাচলে দেড়শো প্রায়
এই দোলাচলেই চলে গেল দেড়শো প্রায় বছর৷ বাঙালির সব মননে, সব প্রেমে, সব সুখে, সব আনন্দে ওই একজন সত্যদ্রষ্টা বাউল আজও গেয়ে যান, বলেন তাঁর পরিচয়...‘একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে/ বসন্তের নুতন হাওয়ার বেগে...' আজও শুনি তাঁর কবিতা,তাঁর কথা, তাঁর অনুভব৷
সুদূর শৈশবে ধরা নির্ভার সেই হাতটি আজও ছাড়তে পারি নি আমরা৷ আজও৷ সার্দ্ধশতবর্ষের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়েও, ‘তুমি যে তুমিই ওগো সেই তব ঋণ....'
প্রতিবেদন-সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা - অরুণ শঙ্কর চৌধুরী