1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তাসের দেশ

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা২ সেপ্টেম্বর ২০১৩

কেউ বলছেন কিউ-কীর্তি, কেউ প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ প্রতিক্রিয়া যাই হোক, বিতর্কিত পরিচালক কৌশিক মুখোপাধ্যায় ওরফে কিউ-এর ছবি ‘তাসের দেশ’-কে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারছেন না, একেবারেই৷

https://p.dw.com/p/19ZRB
ছবি: Overdose Joint

‘তাসের দেশ' নিয়ে চিত্র পরিচালক কৌশিক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের প্রথম কথা হয় গত বছরের ‘কান' চলচ্চিত্র উৎসবের আগে, যখন প্রথম শোনা গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ' চলচ্চিত্রায়িত করছেন কিউ৷ রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন নিগম এনএফডিসি সেই চলচ্চিত্রের সহ প্রযোজক৷ তখন কিউ-এর ছবির সুর-সংযোজনের কাজ চলছিল৷ রবীন্দ্রনাথেরই কথা এবং সুর, কিন্তু এক বহুজাতিক সাংগীতিক উদ্যোগের মিলমিশ ঘটে গড়ে উঠছিল যেন এক নতুন সুরের আবহ৷ একদিকে বার্লিনের আন্ডারগ্রাউন্ড ডিজে মুগ কনস্পিরেসি, সুইস-ফ্রেঞ্চ জ্যাজ ট্রাম্পেট বাদক এরিক ট্রুফাজ, ব্রিটিশ গিটারিস্ট স্যাম মিলস, আর অন্য দিকে বাংলাদেশের আনুশেহ আনাদিল, তবলা বাদক তন্ময় বোস, সুরকার নীল অধিকারী এবং পরিচালক কিউ নিজে৷ কিউ ছবির পুরুষকণ্ঠের গানগুলিও গেয়েছেন৷ এবং তাঁর ‘তাসের দেশ'-এর মূলসুরটি বেঁধে দেওয়া হয়েছে শেষের বাঁধ ভেঙে দাও-এর কোরাসে৷

Tasher Desh Quashik Mukherjee Regisseur
চিত্র পরিচালক কৌশিক মুখোপাধ্যায়ছবি: Overdose Joint

সেই মিউজিক ওয়ার্কশপ এবং রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে বসে কিউ তাঁর ‘তাসের দেশ' সম্পর্কে প্রথম যে কথাটা বলেছিলেন, সেটাই খুব অন্যরকম মনে হয়েছিল৷ কিউ বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে যেমন অনেক লোকই ঠিকমতো বুঝতে পারেননি, তেমনই তাঁর ‘তাসের দেশ' নৃত্যনাট্যটিও প্রায় কেউই বুঝতে পারেননি৷ সবাই চিরকাল এটিকে শিশুদের অভিনয়যোগ্য একটি নাচ-গান নির্ভর আখ্যান হিসেবে দেখেছেন৷ অথচ রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকে ঘুরে এসে ‘তাসের দেশ' লিখেছিলেন৷ তিরিশের দশকের শেষভাগের ইউরোপ, যেসময় জার্মানিতে আডল্ফ হিটলারের হাত ধরে এবং ইটালিতে মুসোলিনির হাত ধরে ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে৷ সেই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের মতো চিন্তক এবং দার্শনিক যখন এক অবরুদ্ধ সমাজ এবং তা ভেঙে দেওয়ার কথা বলে একটা নাটক লেখেন, এবং সেই নাটক তিনি উৎসর্গ করেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবথেকে সাহসী এবং পরাক্রান্ত পুরুষ সুভাষ চন্দ্র বসুকে, তখন গোটা ব্যাপারটাকে ছেলেভুলনো বলে ভেবে নেওয়াটাই মূর্খামি৷

Film Szene Filmstill Tasher Desh Quashik Mukherjee
ছবির একটি দৃশ্যছবি: Overdose Joint

কিন্তু ‘তাসের দেশ'-এর নিজস্ব ভাবানুবাদে শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি কিউ৷ তিনি পত্রলেখা এবং হরতনির সম্পর্কের মধ্যে সমকামিতা এবং যৌনমুক্তির চেতনা খুঁজে পেয়েছেন৷ সেটাও আদৌ গোপনীয়তার মোড়কে ঢাকা নয়, বরং বেশ উচ্চকিত৷ এবং এই যে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা বা যৌন ভাবনার উন্মোচন, এটা কিউ করেছেন একেবারে নিজস্ব স্টাইলে, যাকে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন সাইকাডেলিক হ্যালুসিনেশনেরই নামান্তর হিসেবে৷ অর্থাৎ মাদকাচ্ছন্ন, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় মানুষ যেভাবে বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, বা বলা ভালো পরাবাস্তব আর বাস্তবের সীমারেখা যখন আর স্পষ্ট বুঝে ওঠা যায় না, সেই জগৎকে ছবিতে হাজির করেছেন কিউ৷ তার জন্য তিনি সাহায্য নিয়েছেন হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরার, ফলে ক্যামেরা কখনই স্থির থাকেনি৷ আশ্রয় নিয়েছেন পরাবাস্তবধর্মী সব দৃশ্যকল্প এবং আক্ষরিক অর্থেই দৃষ্টিবিভ্রমকারী রং এবং নকশার৷ তাঁর ‘তাসের দেশ'-এর সৈন্যদের মুখ জাপানি কাবুকি নাচের মুখোশের মতো বিবর্ণ সাদা, শুধু তাদের ঠোঁটে কালো বা লাল রঙে তাসের চিহ্ন আঁকা৷

Rabindranath Tagore
‘তাসের দেশ’ এর লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরছবি: picture-alliance/dpa

কিউ-এর ‘তাসের দেশ' অনেকেরই ভালো লেগেছে৷ অনেকের মনে হয়েছে, এটা নেহাতই কিউ-এর নিজের চেষ্টাকৃত দৃষ্টিবিভ্রম আর মনোবৈকল্যের ছবি৷ এক চিত্রপরিচালক, যিনি বহুদর্শী এবং নিজেও পরীক্ষামূলক সিনেমায় আগ্রহী, তিনি মন্তব্য করেছেন, এই ‘তাসের দেশ' দেখে তাঁর মনে হলো তিনি যেন উডস্টক মিউজিক ফেস্টিভাল দেখতে গিয়েছেন৷ সন্দেহ হয়, এটা সম্ভবত ব্যাজস্তুতি৷ মাদকপ্রভাবিত স্বপ্নদর্শনকে কটাক্ষ৷ কারণ উডস্টক উৎসবের গানবাজনার খ্যাতি যতদূর, তার নেশাগ্রস্থ হুল্লোড় সম্ভবত তার থেকেও অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং সুদূরপ্রসারী৷ কিউ কেন রবীন্দ্রনাথের গানগুলোর সঙ্গে অমন হুজ্জোতি করেছেন, সেই প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন৷

আসলে মাদকজনিত বিভ্রম, যৌনতা, রাজনীতি, অর্থাৎ বাঙালি সমাজজীবনে যে সমস্ত দোষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটা প্রায় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যুক্ত করা এবং সেই সবকিছুকে এক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বেঁধে ফেলার এমন দুঃসাহসকে আর যাই হোক, কেউ অবহেলা করতে পারছেন না৷ তবে রবীন্দ্রনাথ যদি জীবিত থাকতেন, তা হলে তিনি নিজে সম্ভবত খুব খুশি হতেন নতুন যৌবনের দূতেদের এই অদ্ভুত বেয়াড়াপনায়, যারা এক বদ্ধ, গতিহীন সমাজে ভাঙনের জয়গান গাইছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য