চে গেভারা: রোম্যান্টিক, বিপ্লবী, শহীদ, কিংবদন্তি
মাথায় কালো বেরেটের নীচে ঝাঁকড়া চুল, চোখ যেন কোন সুদূরে, গোঁফ-দাড়ি মিলিয়ে এক রোম্যান্টিক বিপ্লবীর এই ছবিটি যেন সকলের মনেই গাঁথা হয়ে গিয়েছে৷ অর্ধশত বছর আগে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন চে গেভারা৷
কিংবদন্তি
এর্নেস্তো ‘চে’ গেভারার জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন, আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের একটি বিত্তশালী পরিবারে৷ পরে তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কিউবার বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন৷ কিউবায় কমিউনিস্ট স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে মতদ্বৈধ থাকলেও, চে যে নির্বিশেষে এক কিংবদন্তি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷
গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে ডাক্তার
চে গেভারা (বাঁয়ে) ও ফিদেল কাস্ত্রো (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়), এই দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৫৫ সালে, মেক্সিকোয়৷ দু’জনে তখন কিউবার একনায়ক বাতিস্তার বিরুদ্ধে গুপ্তপ্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট৷ ১৯৫৮ সালের এই ছবিটিতে চে ও কাস্ত্রো অন্যান্য গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে শলাপরামর্শে রত৷ বাতিস্তা কিউবা ছেড়ে পালান ১৯৫৯ সালের পয়লা জানুয়ারি৷
বিপ্লবী নেতা
কাস্ত্রো আইন করে ‘কমান্দান্তে’ চে-কে কিউবার নাগরিকত্ব প্রদান করেন৷ চে প্রথমে কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ও ১৯৬১ সাল থেকে কিউবার শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ সরকারি যোজনা ও পাঁচশালা পরিকল্পনার পক্ষপাতী ছিলেন চে৷ তাঁর আমলে কিউবায় মার্কিন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় ও গ্রামাঞ্চলে বসতিনির্মাণ ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সংক্রান্ত কর্মসূচি চালু করা হয়৷ বড় বড় ভূস্বামীর জমি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়৷
গরীবের বন্ধু
ডাক্তারি পড়াশুনার সময়েই চে দক্ষিণ অ্যামেরিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন৷ এই যাত্রায় তিনি যে দারিদ্র্য, অভাব-অনটন ও দুর্নীতি দেখেন, তা তাঁকে সারা জীবনের জন্য প্রভাবিত করেছিল৷ কখনো-সখনো তিনি কুষ্ঠাশ্রমেও ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছেন৷ শিল্পমন্ত্রী হিসেবেও তিনি নিজেই হাত লাগিয়েছেন৷ ১৯৬১ সালে হাভানায় সস্তার বাড়ি তৈরির প্রকল্পে মজদুরদের সঙ্গে একদিন কাটান চে (ছবি)৷
শ্রেণীশত্রুর পানীয়
কোকাকোলা কোম্পানির কাছে ছবিটির মূল্য নিশ্চয় অশেষই, কেননা, ১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে উরুগুয়েতে একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক সম্মেলনের অবকাশে চে-কে এক বোতল কোকাকোলা পান করতে দেখা যায়৷
বিপ্লব ছড়ানোর কাজে
১৯৬৫ সালে চে সম্ভবত কাস্ত্রোর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে কিউবা ছেড়ে কঙ্গোয় চলে যান৷ চে-র মিশন ছিল, উত্তর-ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি গুপ্তপ্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা৷ সে কাজে তিনি সফল হতে পারেননি৷
কঙ্গোর পর বলিভিয়ায়
এখানেও চে-কে অনুরূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ দেখা যায়, চাষিরা বিপ্লবে যোগদান করতে নারাজ; কাজেই চে ও তাঁর যোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন৷ গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের সাহায্য করেনি, বরং শত্রুতা করেছে৷ ১৯৬৭ সালে তাঁর খচ্চর চিকো-র সঙ্গে চে-র এই ছবিটি তাঁর শেষ ছবিগুলির মধ্যে গণ্য৷
বিপ্লবী থেকে শহীদ
১৯৬৭ সালের ৮ই অক্টোবর ক্যাপ্টেন গ্যারি প্রাদো-র সৈন্যরা লা ইগুয়েরা-র কাছে চে-কে গ্রেপ্তার করে৷ তার একদিন পরে চে-কে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ হত্যার নির্দেশ সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছিল বলে প্রাদো পরে দাবি করেন৷ বলিভিয়ার জেলখানাগুলো থেকে প্রায়ই বন্দিরা পালানোর চেষ্টা করতো, সেই কারণেই চে-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে প্রাদো জার্মান ডিপিএ সংবাদ সংস্থার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন৷
ফেরা
অর্ধশতাব্দী আগে বলিভিয়ায় ভাইয়েগ্রান্দে শহরের হাসপাতালের এই কাপড় ধোয়ার ঘরটিতে চে-র মরদেহ রাখা ছিল৷ পরে তাঁকে কোনো অজ্ঞাত স্থানে সমাধিস্থ করা হয়৷ ‘‘তোমাকে মাটিতে পুঁতেও ওরা আমাদের তোমাকে খুঁজে পাওয়া আটকাতে পারবে না,’’ ঘরের এক কোণে দেয়ালে লেখা রয়েছে৷ কথাটা সত্যি, কেননা, ৩০ বছর পরে চে-র দেহাবশেষ কিউবায় নিয়ে যাওয়া হয়৷
অমর চে
২০০৮ সালে চে-র ৮০-তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর জন্মের শহর রোজারিও-তে চে’র একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ মূর্তির উন্মোচন উপলক্ষ্যে হাজার হাজার মানুষ রোজারিওতে গিয়েছিলেন৷ চে’র জীবনীকার হর্হে কাস্তানিয়েদার মতে, চে তাঁর ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের কারণে পশ্চিমা জগতে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়ে আধুনিকতার একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন৷
ছবিটি যিনি তোলেন
চে-র যে আলোকচিত্রটি সকলের পরিচিত, সেটি তুলেছিলেন আলবের্তো কর্দা (২০০০ সালের ছবি)৷ কর্দার তোলা আসল ছবিতে আরো অনেক খুঁটিনাটি রয়েছে৷ ১৯৬০ সালে কিছু বন্দরশ্রমিক একটি বিস্ফোরণে প্রাণ হারানোর পর চে তাঁদের সমাধি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন৷ সেখানে তাঁর এই ছবিটি তোলেন আলবের্তো কর্দা৷ চে-র মৃত্যুর পর ইটালির এক সাংবাদিক ছবিটি নতুন করে প্রকাশ করেন৷
বাণিজ্যিক
চে’র প্রতিকৃতি আজ সর্বত্র৷ টি-শার্ট থেকে শুরু করে দেয়ালে টাঙানোর পোস্টার বা চায়ের কাপ, বিয়ারের বোতল কিংবা ছাতা – সব কিছুর উপর চে’র মুখ৷ এই নিছক পুঁজিবাদি ‘মার্চেন্ডাইজিং’ কমান্দান্তে চে’র ভালো লাগতো কিনা বলা শক্ত৷