1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চিকিৎসায় নোবেল কি কলকাতায় যেতে পারত?

১১ অক্টোবর ২০১০

টেস্টটিউব বেবি জন্মের গবেষণায় ধারাবাহিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটেনের ডা. রবার্ট এডোয়ার্ডস-এর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনায় কলকাতার মনে পড়ে গেল ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়-কে৷

https://p.dw.com/p/PawE
বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি লুইস ব্রাউনছবি: AP

১৯৭৮ সালে ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্ম যাঁর হাতে, ডা. এডোয়ার্ডসের সাফল্যের দু'মাস পরেই৷

মর্মান্তিক পরিণতি

কিন্তু সমসাময়িক চিকিৎসক সমাজের সন্দেহ আর সংকীর্ণতা এবং তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবজ্ঞা আর অপমান ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ঠেলে দিয়েছিল আত্মহননের দিকে৷ কিন্তু আজও সেই পরিস্থিতির কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? গভীর বেদনার সঙ্গে ডা. সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বললেন, ‘‘আমাকে এমন পর্যায়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, আমিও আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছি৷ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছি৷ কিন্তু আমি করিনি৷ কারণ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃতদেহ নামানোর সময় আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই কাজটাকে আমি চিরকাল চালিয়ে যাব৷ স্যারের মৃতদেহ ছুঁয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কলকাতা শহরে এই কাজ করে আমি প্রমাণ করব, এই কলকাতাতে বসেই কাজটা করা সম্ভব৷ আমরা তো ওনার কাছ থেকেই, থিয়োরিটিকালি হলেও এই যে সাবজেক্ট, এটা যে হয়, টেস্টটিউব বেবি ব্যাপারটা কী, এগুলো আমি জানতাম না৷ সব ওনার কাছেই শিখেছি৷ কাজেই আমার কাজই প্রমাণ করবে যে সুভাষ মুখার্জি সঠিক ছিলেন৷ এই মনে করেই কাজ শুরু করেছিলাম৷ কিন্তু আজও আমি এক লাইন স্বীকৃতি পাইনি৷ যে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সালে কলকাতায় দ্বিতীয় যে নলজাতক শিশুটি হল, তার নাম ইমরান, সেই কাজে তোমার অন্তত ৫০ শতাংশ অবদান আছে৷''

ডা. ঘোষদস্তিদার ভারতের অন্যতম নলজাতক বিশেষজ্ঞ যিনি নিজের নিষ্ঠা, পরিশ্রম এবং প্রতিভায় ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাবনাকে সার্থক করেছেন, কিন্তু গুরুর মতই, বঞ্চিত হয়েছেন প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে৷

স্বীকৃতি মেলে নি

ডা. ঘোষদস্তিদার বললেন, ‘‘কলকাতার যে চিকিৎসক সমাজ বা বিজ্ঞানী সমাজ, যারা সুভাষ মুখার্জির কাজকে অবিশ্বাস করলেন, বা কী করে করেছেন বুঝতে পারেননি বলে দাবি করলেন, এবং এখন অনেকে বলেন যে উনি সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন, তাই বুঝতে পারেননি, কিন্তু তারপরে আমি যখন কাজ করে গেলাম ধারাবাহিকভাবে, এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছি, এবং সুভাষ মুখার্জির মৃত্যুর পর দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন কাজ হল, ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী এবং আমার, দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায় কাজ হল, তখন কলকাতার গাইনোকোলজিকাল সোসাইটি, বা চিকিৎসকরা যারা ছিলেন, তারা ধরে নিলেন, এটা বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর একার কাজ৷''

নোবেলজয়ীর উৎসাহ

তবে একই বিষয়ে গবেষণার জন্য এবছর নোবেল পুরস্কার পেলেন যিনি, সেই ডা. রবার্ট এডোয়ার্ডস ডা. ঘোষদস্তিদারের প্রচেষ্টাকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, উৎসাহিত করেছিলেন৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডা. ঘোষদস্তিদার বললেন, ‘‘তখন কিন্তু আমরা, এই যে টেস্টটিউব বেবি, তার যে প্রযুক্তি, তার যে ল্যাবরেটরি. তার যে পরিকাঠামো, এইসব সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণাই ছিল না৷ ডা. চক্রবর্তীর কাজ ছিল ক্লিনিকাল পার্ট-টা ডেভেলপ করা, আমার কাজ ছিল ল্যাবরেটরি ডেভেলপ করা৷ ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হবে, জিনিসপত্র কিনতে হবে, ল্যাবরেটরি সাজাতে হবে, তার প্রোটোকল ডেভেলপ করতে হবে, তার পরে কাজ শুরু করা যাবে৷ এবং ১৯৮২ সালে কলকাতা শহরে সারাক্ষণ লোডশেডিং৷ জেনারেটর রাখতে হবে, রাতে জেগে থাকতে হবে, লোডশেডিং হলে জেনারেটর চালাতে হবে৷ কারণ যদি এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকে তাহলেই তো ইনকিউবেটর শেষ৷ কাজেই রাতে জেগে বসে থেকে জেনারেটর চালাতে হত৷ ১৯৮৪ সালে হেলসিঙ্কিতে যখন তৃতীয় আইভিআর ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস হচ্ছে, সেখানেই ডা. এডোয়ার্ডস-এর সঙ্গে আমার আলাপ হয়৷ এবং আমরা এখানে কাজ করছি শুনে, আরো অনেক পাশ্চাত্ত্যের লোকেরা, কলকাতায় কাজ হচ্ছে শুনে, ওখানে তো লোডশেডিং, কী করে কাজ করছ, এরকম যখন বলছিলেন. ডা. এডোয়ার্ডস বললেন, এই তো চাই৷ এই চ্যালেঞ্জটাই নিতে হবে৷ তার মানে আমি ওনার কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট পেলাম, একটা জোর পেলাম যে আমি যা করছি, সেটা কিছু ভুল হচ্ছে না৷''

বিদেশের স্বীকৃতি অপরিহার্য

ডা. ঘোষদস্তিদারের আফসোস, রবীন্দ্রনাথই হন বা অমর্ত্য সেন, বিদেশ থেকে স্বীকৃতি না পেলে ভারতে কারও যথার্থ মূল্যায়ন হয় না৷ তাঁর মতে, ‘‘বিদেশি যে উন্নত সমাজব্যবস্থা, তাদের অ্যানালিটিকাল মানসিকতা নিয়ে বিচার করে কাউকে যদি স্বীকৃতি না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতবর্ষ বুঝতে পারে না৷ আর এখানে যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে, যারা সুভাষ মুখার্জির একটা সামান্য বদলি, বাঁকুড়া থেকে কলকাতা, যেটা তিন দিনের কাজ, মন্ত্রী সই করে দেওয়ার পরেও, আমি সেই ঘটনার সাক্ষী, আমার সামনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য সই করে দেওয়ার সত্ত্বেও, ছ মাস পরেও সেই ট্রান্সফার হয়নি৷ ওনার ফাইল নাকি খালি হারিয়ে যেত!''

কাজেই এখন যে প্রশ্ন উঠছে যে এই নোবেল পুরস্কার কলকাতাতেই আসা উচিত ছিল কিনা, সেটা অর্থহীন বলে মনে করেন ডা. ঘোষদস্তিদার৷ তিনি বললেন, ‘‘সুভাষ মুখার্জির ক্ষেত্রে কি অজ্ঞানতা ছিল, নাকি আরও বড় একটা চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একদল ডাক্তার, এক দল আমলা, একদল পলিটিকাল নেতা, তারা সবাই মিলে সুভাষ মুখার্জিকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজতে হবে৷ সুভাষ মুখার্জিকে এক্ষুনি নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত কিনা, এটা অবান্তর প্রশ্ন৷''

প্রতিবেদন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়

সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন