1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্রিকেটে অর্জন, বাকি সব বর্জন

মোস্তফা মামুন
১৬ ডিসেম্বর ২০২১

৫০ বছরে বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়াবিদ কে? সেরা ৫০ এ-ই বা কারা থাকবেন? দেশের অর্ধশতাব্দী উপলক্ষে ক্রীড়াবিদদের এমন তালিকা করতে কিছু বিজ্ঞ মানুষকে দিয়ে একটা র‍্যাংকিং করিয়েছিলাম৷

https://p.dw.com/p/44LPS
Cricket England - Bangladesch - ICC Champions Trophy
ছবি: Getty Images/J. Mansfield

অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তালিকার উপরের দিকে প্রত্যাশামত ক্রিকেটারদের আধিক্য নেই৷ বরং ফুটবলার, দাবাড়–, বক্সার, শ্যুটাররা ভালোমতোই ঢুকে পড়েছেন৷ তালিকাটা কৌতূহল জাগানিয়া বলে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম৷ তাতে আরেকটা মজার জিনিস বের হল৷ শীর্ষে যেসব ক্রিকেটাররা আছেন, তারা সব এই প্রজন্মের৷ যখন অন্য সব খেলার ক্ষেত্রে তারকারা সব পুরনো দিনের৷ ক্রিকেটে সাকিব-মাশরাফি, ফুটবলে সালাহউদ্দিন-মুন্না৷ দাবায় নিয়াজ-রাণী৷ দেখতে দেখতে মনে হল, এটাই আসলে পঞ্চাশ বছরের খেলা আর খেলার দিকবদল চিত্রিত করে সঠিকভাবে৷ প্রথম দুই-তিন দশক, মানে নব্বই দশক পর্যন্ত ছিল সব খেলা৷ এরপর শুধুই ক্রিকেট৷ পঞ্চাশ বছরের চিত্র খোলা চোখে ক্রিকেটের সাফল্যের গল্প৷ চোখ কচলে দেখলে, আসলে ক্রিকেটের তোড়ে অন্য সব খেলার হারানোর গল্পও৷ একদিকে ক্রিকেটীয় তোরণ তৈরির ঝলমলে ছবি৷ ঠিক তাঁর পেছনের অন্ধকারে অন্য সব খেলার সমাধিক্ষেত্রও৷

পৃথিবীতে খুব কম দেশ আছে (খুব সম্ভবত নেই-ই) যে দেশের প্রধান খেলা বদলে গেছে৷ বাংলাদেশে ছবিটা এমন পাল্টেছে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, ফুটবলের সেই জোয়ারের দিনগুলো সত্যিই কি ছিল! নাকি সেসব অন্য জন্মের ঘটনা৷ নব্বই দশক পর্যন্ত খেলা মানেই ছিল ফুটবল৷ আবার ঠিক ফুটবল নয়৷ আসলে সব খেলা৷ তখনকার সময়ে কোনো খেলার সারাবছর হওয়ার সুযোগ ছিল না৷ কারণ, অত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ছিল না৷ স্পনসরদেরও অত চাপ ছিল না যে জনপ্রিয় খেলাটা থেকে যতভাবে সম্ভব নিংড়ে নেয়া৷ এখন যে কারণে লিগের বাইরে আইপিএল-বিপিএল, ত্রিদেশীয়-চারদেশীয় সিরিজ, তখন ফুটবলের যে রমরমা যে এখনকার মতো স্পনসর আর বাণিজ্য অধ্যুষিত যুগ হলে কত যে টুর্নামেন্ট হত৷ সেসব হলে সারাবছর ফুটবলে মেতে থাকত মানুষ৷ সুবিধা হল তা না হওয়াতে বছরের তিন-চার মাসের ফুটবল মৌসুম বাদ দিলে বাকি সময় হাতে থাকত অন্য খেলার দিকে মনযোগ দেয়ার৷ তাই টিটি, ব্যাডমিন্টনে প্রচুর মানুষ হত৷ বাস্কেটবল-অ্যাথলেটিকসে মনযোগ দেয়ারও সময় ছিল৷ তাই কয়েক মাস ফুটবল৷ বাকি সময় অন্য খেলা৷ ফুটবলারদের দেবতাতুল্য তারকাখ্যাতি৷ কিন্তু মানুষ খেয়াল রাখে বলে সে স্প্রিন্টার শাহ আলমও মনযোগ পান৷ ডানা-মরিয়মদের ব্যাডমিন্টনও উত্তাপ তৈরি করে৷ ছোট খেলার তারকারা সমাদর পান বলে সে-ই খেলায়ও পরের প্রজন্ম আগ্রহ বোধ করে৷ যার যে খেলায় ক্ষমতা বা প্রতিভা সে সেখানটাতে নিজেকে বিকশিত করার চেষ্টা করে৷ সাঁতারু বা বক্সার হলে মোশাররফদের মতো তারকামর্যাদা মেলে বলে কিশোররা সাঁতার কাটে৷ বক্সিংয়েও হাত পাকানোর চেষ্টা করে৷ আবার সেসব খেলায় কিশোর-তরুণদের আগ্রহ আছে সেই সময়ের সীমিত কাঠামোতেও ঠিকই পাড়ায় মহল্লায় বক্সিং খেলার পর্যন্ত বন্দোবস্ত হয়ে যায়৷ ৮০'র দশকের কিশোরদের মনে থাকবে, ১৯৮৫ এশিয়া কাপে বাংলাদেশে হওয়া এবং বাংলাদেশের সাফল্যসূত্রে হকির এমন জোয়ার তৈরি হয়েছিল যে সবাই খেলাটা খেলতে চায়৷ কিন্তু সরঞ্জাম দামী এবং দুর্লভ৷ সমস্যা নেই৷ নিজেরাই বাঁশ দিয়ে বিকল্প তৈরি করে দেশকে বানিয়ে ফেলল হকিময়৷ এভাবেই কখনও বাংলাদেশ সাঁতারময়৷ কখনও বক্সিংময়৷ এবং কখনও ক্রিকেটময়ও৷

তখনও ক্রিকেট ছিল৷ কেউ কেউ আপত্তি করে বলেন, ক্রিকেট তখন দুই নম্বর খেলাও ছিল না কিন্তু এর সঙ্গে একমত নই৷ ক্রিকেট ছিল বিপুল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা দুই নম্বর৷ এখনকার ফুটবলের সঙ্গে তাঁর দারুণ মিল৷ এখন মানুষ ক্রিকেটের চোখে ফুটবলকে দেখে৷ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সাফল্যের সমতুল্য সাফল্য ফুটবলে চায় এবং পায় না বলে খেলাটা এমন অনাদৃত৷ তখন ফুটবলের সমাদর ছিল পুরোই ক্লাবভিত্তিক (যেমনটা পুরো দুনিয়াতে এখনও৷ আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্স এই ফুটবলভিত্তিক এবং সমর্থকপুষ্ট ক্লাবগুলো ক্রিকেট দলও করত৷ অনুগত ক্লাব সমর্থকেরা ক্রিকেটেও সমর্থনসূত্রে মনযোগ রাখত৷ নিজের ক্লাব কেমন করছে না করছে-দেশের ক্রিকেট ছিল এই অঙ্কজাত সমীকরণে৷ তবে ক্রিকেটীয় ভালোবাসা বা উত্তেজনা ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদী৷ ভারত-পাকিস্তান প্রায় আবাহনী-মোহামেডানের কাছাকাছি উত্তেজনা যোগাত৷ ইমরান-গাভাস্কার নিয়ে ধুন্দুমার বিতর্ক৷ এখনকার ফুটবলের সঙ্গে মিলটা পাচ্ছেন তো৷ দেশের ফুটবল নিয়ে উদাসীনতার আড়ালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আর মেসি-রোনালদো নিয়ে প্রায় জীবন-মরণ উন্মাদনা৷ কিন্তু ঐ যে, স্থানীয় ফুটবলের মত তখনকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও সাময়িক, সারা বছরের ব্যাপার নয় বলে উন্মাদনার দিন আসত বছরে এক-দুই বার৷ বাকি অফুরন্ত সময়ে ক্রীড়ামনের অন্য খেলায় মনযোগ দিতে মানা নেই৷

নব্বই দশকে বিশ্ব বদলাল৷ বদলাল বাংলাদেশও৷ খালি চোখে এটাও দেখা যাবে না যে এই ভূ- রাজনীতির বদল কীভাবে ক্রীড়াবোধও বদলাল৷ বিশ্বে সাম্য আর সমাজতন্ত্র পুরনো বলে পরিত্যাজ্য হয়ে চকচকে এক আধুনিক দুনিয়ার ঝলকানি এল৷ খোলা বাজার৷ যোগ্যতা অনুযায়ী যে যতদূর খুশি যেতে পারে৷ মানুষের স্বাভাবিক যে প্রবণতা তার জন্য দারুণ আকর্ষণীয়৷ ব্যক্তিগত বিনিনিষেধের সঙ্গে অর্থ আর বাণিজ্যের বিধিনিষেধও উঠে যাওয়াতে বিনিয়োগ-আর্থিক সচ্ছলতার অফুরন্ত সম্ভাবনা৷ খোলা বিশ্বের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মানুষ তাতে ঝাঁপাল৷ এবং উত্তেজনায় ব্যক্তি মানুষ খেয়াল করল না সে আসলে নিজেকে বিলিয়েই দিচ্ছে৷ আর্থিক অগ্রগতির চেষ্টায় সংস্কৃতি-খেলা সব এমন খেলো ব্যাপার হল যে এর প্রয়োজনই যেন আর ঠিক থাকল না৷ এবং আরেকটা অঙ্ক এল৷ সবকিছু আছে, তবে সেটা এক নম্বরের জন্য৷ জিততে পারলে, অন্যদের পেছনে ফেলতে পারলে তবেই তুমি সফল৷ রাজনীতি আর সমাজের এই অঙ্কের ফেরেই সমস্যায় পড়ল খেলা৷ যে খেলায় তুমি জিতবে, এক নম্বর হবে সেই খেলাটাই খেলবে৷ বাকিটা পয়সা দেবে না৷ মান দেবে না৷ ভালোবাসার কথা বলে এসবে মেতে থাকা বাতিল সময়ের বিলাসিতা৷

এদিকে বিশ্বের এই হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও বদল এসেছে৷ ১৫ বছরের সামরিক শাসন শেষে গণতন্ত্রে দেশ৷ খোলা সমাজ, প্রচুর পুঁজি৷ নতুন ধারার সংবাদমাধ্যম এল৷ এরা দেখল এবং দেখাল ক্রিকেটেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা৷ ততদিনে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে৷ জিম্বাবুয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেছে, এর বাইরে আরও তিনটা দেশ বিশ্বকাপ খেলবে, কাজেই বাংলাদেশের সোনালী সুযোগ৷ সেই সম্ভাবনার অঙ্কই ক্রীড়াবোধ বদলাতে শুরু করল৷ ফুটবলে কিছু হবে না, ক্রিকেটেই ভবিষ্যৎ ধরে এমন একটা হাওয়া তৈরি হল যে বাকি সব খেলার সেই হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার দশা৷ ক্রিকেটে মনযোগ, টাকা, ভালোবাসা সব যোগ হল৷ এসব গায়ে মেখে ক্রিকেট উড়েছে৷ বাকিরা ডুবেছে৷ আবার কেউ কেউ ক্রিকেটের মতো উড়তে গিয়ে পা মচকেছে৷

Bangladeshi sports journalist Mostofa Mamun
মোস্তফা মামুন, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: DW

সেই সময়ের ক্রিকেট সংগঠকরা সম্ভাবনার হাইওয়ে ধরেই চলেছেন৷ চালিয়েছেন৷ ক্রিকেটে সাফল্য এসেছে৷ আরও সাফল্যের সম্ভাবনায় আরও নিজেদের ঢেলে দিয়েছি৷ এসবে কোনো সমস্যা ছিল না৷ ক্রিকেট বাংলাদেশকে যা দিয়েছে, সত্যি বললে বাকি সব খেলা মিলেও সেই সাফল্য দিতে পারেনি৷ সাকিব ক্রিকেটের বিশ্ব পর্যায়ে যে মাত্রায় পৌঁছেছেন বাংলাদেশের আর কোনো ক্রীড়াবিদ এর ধারেকাছে যেতে পারেননি৷ যতটা আগানো উচিত ছিল ততটা ক্রিকেটে পারলাম কিনা সেই প্রশ্ন থাকবে৷ ইদানিংকার ব্যর্থ সময়ে সেটা নিয়ে আরও বড় প্রশ্ন৷ বৃহত্তর ক্রীড়া মানচিত্র বিবেচনায় গেলে ক্রিকেটীয় প্রভাবটা কেবল হারজিতের মধ্যে নেই৷ ক্রিকেট এখন তারুণ্যের স্বপ্ন৷ ক্রিকেটারেরা সবচেয়ে বড় সামাজিক নায়ক৷ এখানেই ক্রিকেট মিলে যাচ্ছে বাণিজ্য আর রাজনীতির অঙ্কের সঙ্গে৷ খেলাটা দেশের এক নম্বর আবেগ বলে বাণিজ্য দুনিয়া এটাকে যতভাবে সম্ভব ব্যবহার করতে চায়৷ আর তাই ক্রিকেটেই সব বিনিয়োগ৷ সামগ্রিক মনযোগ৷ তাতে ক্রিকেটের জৌলুশ আরও বাড়ে৷ মানুষ আরও ক্রিকেটমুখী হয়৷ খেলা বলতে তাই টিকে থাকেল শুধু ক্রিকেট৷ আবার বিশ্ব স্পনসর আর বাণিজ্যের ফেরে খেলাটা চলতে থাকে সারা বছর৷ একসময়ের শীতের খেলা এমন ষড়ঋতুর ব্যাপার হয়ে গেছে যে অন্য দিকে মনযোগ দেয়ার সময়ই নেই৷ সবাই ক্রিকেট দেখে, কেউ কেউ চেষ্টা করে৷ না পারলে বাদ দেয়৷ নিজের সন্তানের অন্য খেলায় প্রতিভা আছে দেখলেও উৎসাহিত হওয়ার বদলে আতঙ্কিত হয় মানুষ৷ সম্ভাবনাহীন একটা খেলায় মেতে যদি ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে বসে৷ কাজেই সামান্য কিছ মানুষ শেষপর্যন্ত খেলে৷ এতে করে সামগ্রিকভাবে একটা ক্রীড়াবিমুখতাও তৈরি হচ্ছে৷ রাস্তার ধারে বা মাঠে দলে দলে বাচ্চারা খেলছে সেই দৃশ্য এখন পুরনো আর্কাইভেই মেলে শুধু৷

৫০ বছর পূর্তির দিনে লেখাটা লিখতে বসে এই ছবি হারিয়ে যাওয়ার দুঃখটা খুব বুকে বাজে৷ ক্রিকেটানন্দ আবার সেটাকে ভুলিয়ে রাখে৷ এই ভুলে থাকি বলে তবু কিছু আনন্দ নিয়ে বাঁচি৷ আবার ভুলে থাকি বলে অন্য খেলাকে অবহেলার ভুলটা বয়েই চলে৷

অর্ধশতাব্দীর খাতার শেষ পাতায় বোধহয় এটাই লেখা হবে৷ ক্রিকেটে অর্জন৷ বাকি সব বর্জন৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান