কোলনে গ্রীষ্মের রূপ
১৬ জুলাই ২০১৩আশেপাশে কোথাও গ্রীষ্মের ছোঁয়া নেই৷ তার বদলে সারাক্ষণ ভারি বর্ষণ আর ঝড়ো হাওয়া৷ থার্মোমিটারের কাঁটা ২০ ডিগ্রির ঘর ছুঁই ছুঁই করছে৷ ভাবছি সানগ্লাস-এর বদলে একটি ছাতা পেলে মন্দ হতো না৷ ভিজে যাওয়ার ভয়ে একটি দোকানের সামনে বাড়ানো ছাদের নীচে আশ্রয় নিলাম৷ পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক তাঁর মোবাইল ফোনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখছেন৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আবহাওয়া কি ভালো হতে পারে?'' ‘‘নাহ! আজ এরকমই থাকবে৷'' বিরক্তির সাথে কথাটুকু বলেই নিজের ছাতা খুলে হাঁটা দেন তিনি৷
গ্রীষ্মের সন্ধানে
তবে আমি আশাবাদী৷ গ্রীষ্ম নিজে থেকে দেখা দিতে না চাইলেও আমি তাকে খুঁজবই৷ আমার ইচ্ছা এখন কোলনের দক্ষিণ দিকটায় রাইন নদীর ধারে যাওয়া৷ রাইন ছাড়া তো কোলনের কথা ভাবাই যায় না, তাই এই নদী ধারেই শুরু করি আমার গ্রীষ্ম খোঁজার যাত্রা৷
কোলন নগরীর দক্ষিণ দিকটার সৌন্দর্যময় নতুন এলাকা হলো রাইনাউহাফেন বা রাইনাউ বন্দর৷ একসময় এখানে মাল ওঠা-নামা করা হতো৷ তাই সেই সময় এই জায়গাটা ছিল কোলাহল ও আবর্জনা ভরা৷ কিন্তু এখন এখানকার সবকিছুই নতুন করে সাজানো হয়েছে৷ একেবারে ঝকঝকে, তকতকে৷ আমার সামনে ক্রেনের মতো উঁচু বাড়িগুলো যেন ধূসর আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে৷ সব বাড়িই গ্লাস এবং ইস্পাত দিয়ে তৈরি৷ যেন বন্দরের ক্রেনগুলোই এমনভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আর সেগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন অফিস ও ঘর-বাড়ি৷ ডোমের পাশাপাশি এই সব দৃশ্যমান স্থাপনা এখন কোলনের দিগন্তে নতুন প্রতীক চিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে৷
বাড়ি-ঘর, দোকানপাট ও আর্ট গ্যালারি
আশেপাশে এখন শুধুই দামি বাড়ি-ঘর, সৌখিন দোকানপাট ও আর্ট গ্যালারি৷ কাচের জানালা দিয়ে অসংখ্য বাহারি জিনিস এবং আসবাবপত্র দেখতে পেলাম৷ তবে বাড়িগুলোর মাঝে কোন সবুজ ফাঁকা জায়গা কিংবা কোনো গাছের দেখা পেলাম না৷ আর বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে খুব জোরে হাওয়া বয়ে যাওয়ায় যেন বাঁশির সুর বাজে৷
সবকিছু সত্ত্বেও একটু প্রশান্তির ছোঁয়া
সামনে এগুনোর আগেই একটি সোনার দোকানের সামনে একটি ছোট্ট বাজার চোখে পড়ে৷ সোনালি রঙের পতাকাগুলো বাতাসে দুলছে৷ দোকানঘরের সামনে বাড়িয়ে দেওয়া ছাদের শেষটা প্লাস্টিক পাত দিয়ে ঘেরা৷ পাশেই মেলে রাখা অনেকগুলো বড় বড় ছাতার নীচে প্রায় এক ডজন মানুষ উঁচু টেবিলের কাছে ছুটে যায়৷ আমাকে দেখে বন্ধুসুলভ মুচকি হাসি দেন অলংকার ডিজাইনার মনিকা গিমবর্ন-ইয়োখুম৷ তিনি বলেন, ‘‘যখন বৃষ্টি হয়, তখন মানুষগুলো দোকানঘরে চলে যায়৷ আবার বৃষ্টি থামলেই সবাই ফিরে আসে৷'' আমার কাছে এটাকে কোলনের প্রশান্তি বলে মনে হয়৷
যাহোক, খুব বেশিক্ষণ সেখানে থাকা হলো না৷ রাইনাউহাফেনকে পেছনে রেখে এগুচ্ছি৷ কোলনের দক্ষিণ শহরতলীটা, মানে ‘স্যুড স্টাট' খুব বেশি বড় নয়৷ ফলে মানুষ পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখতে পারে৷ তবে এই এলাকাটা কোলনবাসীর কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়৷ কারণটা বুঝতে খুব একটা সময় লাগল না৷ অসংখ্য ছোট ছোট রেস্তোঁরা, ক্যাফে এবং দোকান-পাট এই এলাকার রাস্তাগুলোকে কিংবা বলা যায় গোটা হাঁটার পথকেই একটি সারিতে বা ছন্দে বেঁধে রেখেছে৷ ক্যাফেগুলোর খোলা জানালার পাশে বসে খদ্দেররা হৈ-হুল্লোড় করে৷ কেউ কেউ পথের ধারে পেতে রাখা বিশাল ছাতার নীচে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে৷ তার সাথে চলে ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় বিয়ার ‘ক্যোলশ' পান এবং আড্ডা৷ রাস্তার উল্টোদিকে আরেক পানশালায় চলে জ্যাজ সংগীতের আসর৷ এদিকে হঠাৎ দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে৷ মনে আশা জাগে, এবার নিশ্চয় কোলনের গ্রীষ্মের খুব কাছে এসে গেছি৷
খুঁজে নিতে হয় সৌন্দর্য
কোলনকে সেই অর্থে হয়ত সুন্দর নগরী বলা যায় না৷ কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে৷ এরপর পঞ্চাশের দশকে পরিকল্পনা মতো দ্রুত নতুন করে গড়ে তোলা হয় শহরটিকে৷ সে যাই হোক, স্যুড স্টাট আমার কাছে সবদিক থেকেই খুব সুন্দর মনে হয়৷ তবে সেটা শুধু মানুষের আন্তরিকতার জন্যে নয়৷ এখানে এখনও সেই পুরানো স্থাপনার অনেক ঘর-বাড়ি আছে৷ রাস্তায় সারি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন গাছগুলো৷ আবার রাস্তার মোড়ে আইল্যান্ডে কে যেন কলা গাছ লাগিয়েছে৷
এই এলাকার বিশেষ সৌন্দর্য হলো ছোট ছোট চত্বরগুলো৷ এসব চত্বর বা মোড়ে এসে মিলেছে অনেকগুলো রাস্তা৷ এগুলোরই একটি হলো আয়ারপ্লেৎশেন বা ডিমচত্বর৷ আসলে এটির নাম মাইনৎসার স্ট্রাসে৷ কিন্তু এটি অনেকটা ডিম্বাকৃতির বলে কোলনবাসীরা কোনো এক সময় এটির নাম এভাবে পাল্টে দিয়েছে৷
হঠাৎ রৌদ্রের আবির্ভাব
হঠাৎ করেই দেখি আকাশে মেঘের দল একটু সরে গেল৷ আর সেই ফাঁকে উঁকি দিল এক ঝলক রোদ৷ আয়ারপ্লেৎশেন-এর লোকজনও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো৷ ক্যারিবিয়ান আমেজ জার্মানির মাঝখানে৷ আমার মনে হলো, অবশেষে আমি কোলনের গ্রীষ্মের দেখা পেলাম৷