কে ঠিক, বিকাশ ভট্টাচার্য না কুণাল ঘোষ?
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে একগুচ্ছ মামলা চলছে হাইকোর্টে। বিভিন্ন মামলায় চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষে আইনি সওয়াল করেছেন বিকাশ ভট্টাচার্য। তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলেছে চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ।
অভিযুক্ত বিকাশ
স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনি লড়াই চলছে বহুদিন ধরে। 'বঞ্চিত' চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে বারবার আদালতে সওয়াল করতে দেখা গিয়েছে বাম সাংসদ, আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যকে। নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় যুক্ত হয়ে তিনি খুবই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন।
সেই বিকাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন এসএলএসটি-র নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষার চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, এই প্রবীণ আইনজীবী তার সহযোগীর মাধ্যমে বিপুল টাকা 'ফি' নিয়েও কার্যত তাদেরই বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।
গত সপ্তাহে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষের সঙ্গে বৈঠক করেন এই চাকরিপ্রার্থীরা। তারপর সাংবাদিক বৈঠকে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন তারা। চাকরিপ্রার্থীদের বক্তব্য, বিকাশের সহকারী, আইনজীবী দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় মামলা লড়ার 'ফি' হিসেবে ২৭ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে। শারীরশিক্ষার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি শুনানিতে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা ও কর্মশিক্ষার প্রত্যেক শুনানিতে ৭০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
চাকরিপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে কুণাল বলেন, ''আইনজীবীদের একটা অংশ তাদের আর্থিক স্বার্থে মামলাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছেন। সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কার্যত বাধা তৈরি করছেন, প্যানেল আটকে দিতে চাইছেন। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।''
বিকাশের অস্বীকার
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশ ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের অগ্রণী আইনজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তিনি রাজ্যসভার সিপিএম সাংসদ। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ডয়চে ভেলে।
তিনি বলেন, ''সম্পূর্ণ অসত্য অভিযোগ। আদালতে সওয়াল করে বেআইনি নিয়োগ আটকে দিতে পেরে আমি গর্বিত। চাকরিপ্রার্থী ও জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই অভিযোগ আনা হয়েছে। এটা ওদের রাজনৈতিক কৌশল।''
তৃণমূল নেতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিকাশের বক্তব্য, ''তদন্তে আমি দোষী প্রমাণিত হলে আমাকে প্রকাশ্যে চাবুক মারুন। আর মিথ্যে প্রমাণিত হলে, নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে কুণাল ঘোষকে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেক চাকরিপ্রার্থী চপেটাঘাত করবেন।''
নবম থেকে দ্বাদশের যে চাকরিপ্রার্থীরা হাজার দিনের বেশি অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা এই ধরনের অভিযোগ শুনে কিছুটা বিস্মিত। নদিয়ার প্রার্থী আবু নাসের ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''বিকাশ ভট্টাচার্য প্রথম থেকেই মামলা লড়ছেন। কিন্তু এজন্য তিনি টাকা নিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।''
আইনজীবীর জুনিয়র দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেননি। এমন দাবিও করেননি যে, বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়া হচ্ছে। তার ভাষায়, ''শুনানিতে যে ফি নেয়ার কথা, সেটাই আবেদনকারীরা দিয়েছেন। সেই অঙ্ক ২৭ লক্ষ কি না তা বলা সম্ভব নয়। টাকা শুনানির ভিত্তিতে নেয়া হয়, এককালীন নয়।''
জুনিয়রদের ফি নেয়ার কথা অস্বীকার করেননি বিকাশ। তিনি নিজে টাকা নেননি, এ কথা জানিয়ে আইনজীবী বলেন, ''কে কাকে কত টাকা দিয়েছেন, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে মামলা বিনা পয়সায় হয় না। যে জুনিয়রকে টাকা দিয়েছেন, ওরা নিশ্চয়ই দেখিয়েছেন যে, কত টাকা খরচ হতে পারে।''
আবেদনকারীর বিরুদ্ধাচরণ?
পেশাগত ভাবে পারিশ্রমিক নেয়া কোনো আইনজীবীর পক্ষে অন্যায় নয়। অধিকাংশ আন্দোলনকারী এ ব্যাপারে একমত। তাদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, 'বঞ্চিত' প্রার্থীদের বড় অংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাই এই লড়াইয়ে বেশি 'ফি' না নেয়াই কাম্য।
তবে শারীরশিক্ষা ও কর্মশিক্ষার চাকরিপ্রার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন, টাকা নিয়েও বিকাশ ভট্টাচার্য ও তার সহকারীরা আবেদনকারীদের চাকরি লাভের পথে বাধা তৈরি করছেন। তাদের বক্তব্য, সরকার চাকরির ব্যবস্থা করতে চাইলে আটকে দেয়া হচ্ছে। যে আবেদনকে হাতিয়ার করে নিয়োগ আটকানো হচ্ছে, তার শংসাপত্র ভুয়া। পারিশ্রমিক নিয়েও কেন বাধা তৈরি করছেন বিকাশ ভট্টাচার্য?
এই বক্তব্য সঙ্গে সহমত পোষণ করেন নাসের-সহ চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। নাসেরের বক্তব্য, ''শুধু ওএমআর শিট জালিয়াতি করে প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে, এমন নয়। র্যাংক অদলবদল করা হয়েছে। অন্য পন্থাও নেয়া হয়েছে। অযোগ্য শিক্ষকদের বাদ দিলেই সব প্রার্থীর নিয়োগের জায়গা তৈরি হবে না। তাই সরকার যে 'সুপারনিউমেরারি' বা অতিরিক্ত পদে নিয়োগ করতে চাইছে, সেটা সকলের চাকরি পাওয়ার পক্ষে জরুরি। তাতে কেন বিকাশ ভট্টাচার্য বাধা দিচ্ছেন, আমরা বুঝতে পারছি না।''
মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির নীচে শারীরশিক্ষা ও কর্মশিক্ষার চাকরিপ্রার্থীরা অবস্থান করছেন। কুণাল বলেন, ''ওদের মঞ্চে গিয়ে কথা বলার পর আমি বিষয়টি যথাস্থানে জানাই। পরের দিন ধর্না মঞ্চে দুজন আধিকারিক যান। তারপরই পদ তৈরি করে সুপারিশপত্র দেয়া হয়। কিন্তু পাল্টা মামলা হওয়ায় নিয়োগপত্র দেয়া যাচ্ছে না, যে মামলাটি লড়ছেন বিকাশ ভট্টাচার্য।''
এই অভিযোগের জবাব বিকাশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''অতিরিক্ত পদ তৈরি করা আইনবিরুদ্ধ, সংবিধানবিরুদ্ধ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা এতদিন লড়াই করেছেন, তারা এতে দুর্নীতির পাঁকে পড়ে যাবেন। এটা তৃণমূল থেকে ওদের বোঝানো হয়েছে। কয়েকজনের সুবিধার জন্য আইনবিরুদ্ধ কাজ করা কোনো সৎ মানুষের উচিত নয়।''