চার দিনে মিলল ২৯৩০ জন শিশুর খোঁজ!
২৫ এপ্রিল ২০১৮১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রতি বছর বহু শিশু নিখোঁজ হয়৷ পুলিশ-প্রশাসনের হাতে খুব সহজে তাদের খুঁজে বের করার কোনো পথই ছিল না এতদিন৷ এবার বোধহয় সেই সমস্যা মিটতে চলেছে৷ নিখোঁজ শিশুদের খুঁজে বের করতে একটি সফটওয়্যারের প্রয়োগ হবে কি হবে না, তা নিয়েই টানাপোড়েন চলছিল৷ দিল্লি পুলিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আইনি লড়াই চালাচ্ছিল নোবেল জয়ী সমাজসেবী কৈলাশ সত্যার্থীর সংগঠন ‘বচপন বাঁচাও আন্দোলন' বা বিবিএ৷ দীর্ঘ চাপানউতোরের পর আদালতের নির্দেশে বিবিএ-র তৈরি এফআরএস সফটওয়্যার ব্যবহার করে পুলিশ৷ আর তাতেই এলো বিপুল সাফল্য৷
গত ৫ এপ্রিল দিল্লি হাইকোর্টে এই সফটওয়্যার নিতে অস্বীকার করে পুলিশ৷ তারপর ৬ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে মাত্র চারদিনে ভারতের রাজধানী শহরে খোঁজ মিলল ২৯৩০ জন নিখোঁজ শিশুর৷ ১০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক মারফৎ আদালতে নিখোঁজ শিশু শনাক্তকরণের এই তথ্য পেশ করেছে পুলিশ৷ নিখোঁজ করে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়াই এখন পুলিশের প্রধান কাজ৷ শিশু বিষয়ক মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এবার আদালতে ‘ন্যাশনাল চাইল্ড ট্রাইব্যুনাল' গড়ার আর্জি জানাতে চলেছে বিবিএ৷ ঠিক যেমন রয়েছে ‘ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল'৷
প্রসঙ্গত, নিরাপত্তার স্বার্থে এই সফটওয়্যারের খুঁটিনাটি জানানো হয়নি৷ তবে বর্তমানে এই সফটওয়্যারের ব্যবহার হচ্ছে দু'টি পদ্ধতিতে৷ জিওমেট্রিক এবং ফোটোমেট্রিক৷ জিওমেট্রিক পদ্ধতি মূলত অবয়ব-নির্ভর৷ মুখমণ্ডলের বৈশিষ্ট বিশ্লেষণ করে দু'টি ছবির বাহ্যিক অবয়ব ও প্রতিটি প্রত্যঙ্গের বৈশিষ্ট ও তাদের মধ্যে ব্যবধান পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয় এটি৷ অন্যদিকে, ফোটোমেট্রিক পদ্ধতিও একটি সমাধান পদ্ধতি৷ এতে নিখোঁজ শিশুর ছবিটিকে পিক্সেলে ভাগ করা হয়৷ এবার অপর ছবিটিকে একই ভাবে পিক্সেল-এর আকারে টুকরো টুকরে করে সেই পিক্সেল-তথ্য যাচাই করা হয়৷
‘বচপন বাঁচাও আন্দোলন'-এর প্রাক্তন সম্পাদক তথা দুঁদে আইনজীবী ভূবন রিভু ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তথ্য-ভাণ্ডার গড়ার কাজ শুরু করেছিল বিবিএ৷ তথ্যভাণ্ডারে দেখা যায়, প্রায় সাত লক্ষ শিশু নিখোঁজ আছে৷ এক লক্ষের মতো শিশু বেশ কিছু সংস্থার তত্ত্বাবধানে রয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তির পক্ষে ছবি মিলিয়ে দেখে শিশুদের শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব৷ এরপর এই সফটওয়্যারের ব্যবহার নিয়ে পুলিশ বহু টালবাহানা করেছে৷ শেষ পর্যন্ত পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে পুলিশ চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউশনে থাকা ৪৫ হাজার শিশুর সঙ্গে ৪৫ হাজার নিখোঁজ শিশুর তথ্য যাচাই করা হয়৷ তাতেই প্রায় তিন হাজার শিশুর সন্ধান মিলেছে৷''
কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছরে দেশে মোট ২,৪০,০০০ শিশু নিখোঁজের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে৷ স্বভাবতই বাস্তবিক সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি৷ বেশ কিছু সংগঠন এই নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে৷ তাদের হিসেব বলছে, ভারতে প্রতি বছর নিখোঁজ হওয়া শিশুর সংখ্যা ৫,০০,০০০ জন৷ এখন নিখোঁজ শিশুদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক দেশব্যাপী একটি অনলাইন তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্র্যাক চাইল্ড'৷ এখানে নিখোঁজ ও খুঁজে পাওয়া শিশুদের ছবি পোস্ট করা যায়৷ দেখা যায় বিবরণ৷ এছাড়া ওয়েবসাইটে ক্লিক করে পুলিশে খবরও দেওয়া যায়৷
২০১৩ সালে শিশু নিখোঁজ বিষয়ে মামলা দায়ের করেছিল ‘বচপন বাঁচাও আন্দোলন'৷ সেসময় সুপ্রিম কোর্ট একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল৷ এরপর দিল্লি হাইকোর্টে আরও একটি মামাল শুরু হয়৷ সেই মামলায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিবিএ নিখোঁজ শিশুদের শনাক্তকরণে দিল্লি পুলিশকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাদের তৈরি এফআরএস সফটওয়্যার দিতে চাইলেও তা নিতে অস্বীকার করে পুলিশ৷ আদালত দিল্লি পুলিশকে চলতি বছরের বিগত ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিবিএ-র তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফলাফল পেশ করার নির্দেশ দিয়েছিল৷ তারপর যা ঘটেছে তা চমকপ্রদ৷
দিল্লি পুলিশের পক্ষে পুরো বিষয়টি হাতে-কলমে করেছেন এমন হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে একজন হলেন দিল্লির জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) অলোক কুমার৷ তিনি জানিয়েছেন, ‘‘মুখমণ্ডল চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি বা ‘ফেসিয়াল রিকগ্নিশন সিস্টেম' সফটওয়্যার ব্যবহার করে সাফল্য এসেছে ঠিকই, তবে কিছু সমস্যাও আছে৷ এই সফটওয়্যার তিন বছর ও তার চেয়ে কম বয়সি শিশুদের শনাক্তকরণ করা সম্ভব নয়৷ কারণ এত কম বয়সে মুখমণ্ডলে পরিবর্তণ হয়ে থাকে৷'' অন্যদিকে, এই সফটওয়্যারের সাফল্য দেশের শিশুরক্ষায় নতুন দিশা এনে দিয়েছে বলে মনে করছে ‘দ্য ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশান অফ চাইল্ড রাইটস' বা এনসিপিসিআর৷ সংস্থার সদস্য যশোবন্ত জৈনের কথায়, ‘‘এই ধরনের আধুনিক পদ্ধতি নিখোঁজ শিশুদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সহায়ক হয়ে উঠবে৷ তাই এই আরও বেশি ব্যবহার প্রয়োজন৷''