একটি মৃত্যু ও অনেক প্রশ্ন
২৭ জুলাই ২০১৬কিশোরটির হাতের তালুতে, ঊর্ধবাহুতে এবং বাহুসন্ধিতে গভীর ক্ষত ছিল৷ ভাঙা কাচ, বা ঐ ধরনের কোনো ধারাল জিনিসের আঘাতে যে ধরনের ক্ষত হয়৷ ছড়িয়ে পড়ে দু'টি সম্ভাবনার কথা৷ হয় কেউ তাকে ভাঙা বোতল দিয়ে মারাত্মক আঘাত করেছে, যার ফলে সে মারা যায়৷ অর্থাৎ এটা খুন! অথবা, ছেলেটি নিজেই কোনোভাবে পড়ে যায় ভাঙা কাচের ওপর এবং গুরুতর চোট পায়৷ অর্থাৎ এটা দুর্ঘটনা!
কোনটা যে সত্যি, তার তদন্ত এখনও চলছে৷ সম্ভবত বেশ কিছুটা সময় লাগবে আসল ঘটনা সামনে আসতে৷ কিন্তু তার আগেই যে সব আনুষঙ্গিক তথ্য সামনে এসেছে, সেগুলো অত্যন্ত অস্বস্তিকর৷ এক কিশোরের অকালমৃত্যুর শোক ছাপিয়ে যেগুলো বৃহত্তর, গভীরতর কিছু সামাজিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ লোকে বিস্মিত, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, কিন্তু তার থেকেও বেশি চিন্তিত৷
প্রথমত, যে মেয়েটির জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার নাম করে ওই কিশোর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, সেই মেয়েটির ঠাকুমা তিন দিন আগেই মারা গেছেন৷ তার পরেও মেয়েটির যারা বন্ধু, তারা মেয়েটির জন্মদিনে ‘সারপ্রাইজ পার্টি' দেবে বলে ওর বাড়িতে গিয়েছিল৷ মেয়েটির বাড়ি থেকে তাদের বলা হয়েছিল, এই শোকের আবহে বাড়ির মধ্যে কিছু না করে, বাইরে গিয়ে পার্টি করতে৷
প্রশ্ন উঠছে, এরা কী রকম বন্ধু যে একটি বাড়িতে শোকাবহ একটি মৃত্যুর ঘটনা জেনেও জন্মদিনে ‘পার্টি' দেওয়ার জন্য নেচে ওঠে? এবং মেয়েটির বাড়িতেই বা শোক কতটা আন্তরিক যে বাড়ির বাইরে গিয়ে পার্টি করার অনুমতি দেওয়া হয়? বাড়ির মধ্যে থাকলে শোকপালন, বাড়ির বাইরে উৎসব? এ কেমন শোক? প্রশ্ন উঠেছে৷
বাড়ির বাইরে জন্মদিন পালন করতে সবাই মিলে গিয়েছিল কাছের একটি উচ্চকোটির ক্লাবে৷ সেখানে অনেকেই মদ্যপান করেছিল, যাদের মধ্যে এই কিশোরও ছিল৷ প্রশ্ন উঠেছে, জন্মদিনের পার্টি করতে বিত্তবানের ক্লাবে যায় যে ১৭/১৮ বছরের ছেলে-মেয়েরা, তাদের আর্থিক সামর্থ ঠিক কত? সেই অর্থ কারা জোগায় তাদের? বাবা-মায়েরা? তা হলে ঠিক কীভাবে তাঁরা মানুষ করতে চাইছেন সন্তানদের? নাকি বাড়িতে, সংসার এবং সন্তানদের নিজেরা যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না বলেই মাত্রাতিরিক্ত পকেট খরচ দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে চাইছেন? অর্থ দিয়ে ঢাকতে চাইছেন নিজেদের অপরাধবোধ? সেই অর্থে ছেলে-মেয়েরা ক্লাব সংস্কৃতির বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে৷ কৈশোরেই তাদের আসক্তি হচ্ছে মদ্যপান এবং অন্যান্য নেশায়৷ অপরিণত বয়সে এবং অপরিণত মাথায় সেই নেশা থেকে খুন অথবা দুর্ঘটনা ঘটার দায় তা হলে কে নেবে?
আর এ সবের বাইরে যে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে, সেটা আরও অস্বস্তিকর৷ দল বেঁধে মেয়েটির বাড়িতে আসা, সেখান থেকে ক্লাবে যাওয়া, খানাপিনা, ফের ওই আবাসনে ফিরে আসা — সব সময় ঐ কিশোর ছিল বন্ধুদের সঙ্গে৷ অথচ যে মুহূর্তে সে দুর্ঘটনায় পড়ল, অথবা মতান্তরে বন্ধুদেরই কারও হাতে আক্রান্ত হলো, তখন তার পাশে আর কেউ থাকল না৷ যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে সে এসেছিল, সে পালালো সবার আগে৷ তার পরে বাকিরাও৷ আহত, রক্তাক্ত শরীরে ছেলেটি পড়ে ছিল একা৷ কেউ তাকে সাহায্য করার ছিল না৷ প্রশ্ন হলো, এ কেমন বন্ধু, যে আরেক বন্ধুকে বিপদের মধ্যে ছেড়ে পালিয়ে যায়? এ কৈশোরই বা কেমন, যা আক্রান্ত, অসুস্থ, আহত, অসহায়কে সাহায্য করতে শেখায় না! যে বয়সে ছেলে-মেয়েরা অপরিচিত, অনাত্মীয়ের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই বয়সের ধর্মও কি এদের চেতনায় নেই? রক্তে নেই সেই জোশ, যা নিজের কথা ভুলে আগে অন্যের কথা ভাবতে প্ররোচিত করে? আর বন্ধুত্ব, যা জীবনের সবথেকে নিঃস্বার্থ, আন্তরিক এবং পারস্পরিক সম্পর্ক, তার মর্যাদা দিতেও শেখেনি এরা?
আর এ সবের মধ্যে থেকেও উঠে আসছে সেই অমোঘ প্রশ্ন — এ কোন নির্মম ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা?
বন্ধু, সত্যি কি আমরা এক নির্মম ভবিষ্য়তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? লিখুন নীচের ঘরে৷