1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এ ইউরোপ সে ইউরোপ নয়

২১ মে ২০১৮

গরিব দেশ থেকে যে সব মানুষ ধনি দেশে আসার চেষ্টা করেন, তারা মরিয়া৷ চরম হতাশার হাত থেকে তারা পালিয়ে বাঁচতে চান৷ কিন্তু যে স্বর্গে তারা পৌঁছাবেন বলে মনে করছেন, সেই স্বর্গ যদি ইতিমধ্যে বদলে গিয়ে থাকে?

https://p.dw.com/p/2y0QR
ছবি: picture alliance/dpa/W. Rothermel

১৯৭৯ সালে প্রথম জার্মানিতে আসি৷ তখন ভারতে খালিস্তান আন্দোলনের ফলে শিখ ধর্মালম্বীরা জার্মানিতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে শুরু করেছেন৷ পরে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধের সময় তামিলরা আসতে শুরু করেন৷ তখনো পর্যন্ত যেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের সঙ্গে রাজনীতির সংযোগটাই বেশি ছিল৷

আজ যদি বলি যে, রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতির তাড়নাই মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে, তাহলে স্বভাবতই অনেকে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া কিংবা সোমালিয়ার মতো দেশের দৃষ্টান্ত দেবেন – এবং তাতে ভুলেরও কিছু নেই৷ ব্যাপারটা এইভাবে দেখা যেতে পারে: রাজনীতির বিপত্তি এড়াতে মানুষ যখন অন্য দেশে যাওয়ার কথা ভাবে, তখন সেই ভিনদেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ছাড়া অর্থনেতিক সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা, সে কথাটাও তারা ভেবে দেখে বৈকি৷

উদ্বাস্তু সংকট, অভিবাসন, দেশ ছাড়া, এ সবের পিছনে হাজারটা মানবিক কাহিনি, সহস্র মানবিক ট্র্যাজেডি লুকিয়ে রয়েছে৷ আর রয়েছে মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি: নিজের এবং নিজের পরিবারের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর প্রচেষ্টা৷ ইউরোপের সব দেশই ভিয়েনা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী, ইউরোপের সব দেশেই রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করা যায়৷ তবুও জার্মানি কিংবা সুইডেনে যেতে পারা একটা আলাদা ব্যাপার৷ 

ইউরোপ চলো!

‘পলিটিক্যাল করেক্টনেস' মাথায় রেখে যদি ভাই-বেরাদারদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, তাহলে বলতে হয় যে, ইউরোপে আসব বললেই তো আর ইউরোপে আসা যায় না৷ অমুক ভাই বাড়িঘর, জমিজেরাত বেচে, কোন এক দালালকে টাকা দিয়ে, তুর্কি হয়ে, রাবারের ডিঙিতে সাগর পেরিয়ে গ্রিসের লেসবসে পৌঁছে – সেখানেই ফেঁসে গেছেন – বা গিয়েছিলেন৷ এবার নাকি তাকে ডাঙার রাস্তা ধরে উত্তরে নিয়ে যাচ্ছে আরেক সম্বন্ধি, তিনিও কিছু কম নেন না৷

তমুক ভাই তো গ্রিসের পথ না ধরে, মিশর হয়ে লিবিয়া গিয়ে, সেখান থেকে ইটালিতে পৌঁছেছেন৷ সেখানকার ভাইরা জার্মানের খবর জানেন – তারা বলছেন, এহানেই থাইক্যা যান৷ জার্মানি তো আর সে জার্মানি নাই, ইউরোপও আর সে ইউরোপ নাই৷ যেখানে কাজকর্ম আছে, মাথা গোঁজার জায়গা আছে, সেখানে যাহোক করে দিন কাটিয়ে দেন৷ দেখবেন ইটালিতে আমাগো দ্যাশের লোক আফ্রিকার মানুষজনের চেয়ে বেশি কদর পায়, তাড়াতাড়ি কাম পায়, কি দোকানপাট কিছু একটা খুলে বসে৷ এ দেশে আইন কিছুটা ঢিলেঢালা৷ জার্মানিতে অ্যাসাইলামদের দেয় বেশি, তবে নজরও রাখে বেশি৷ আর শুনেছেন তো, অদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি এবার সেন্টার খুইল্যা সেখানে ডিপোর্টেশনের কেসগুলিকে রাখব৷ কাগজ না থাকলে নাকি যে দেশের লোক, সে দেশের কাছে কাগজ তলব করব, কাগজ না দিলে উন্নয়ন সাহায্য কমাইয়া দিব৷

এ সব কিছুর খানিকটা শোনা, খানিকটা জানা, বাকিটা কল্পনা – কিন্তু পুরোটাই কেমন যেন সত্য৷ উদ্বাস্তু, শরণার্থী, অভিবাসীদের চেয়ে বাস্তববাদী আর কেউ নেই৷ দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতেই যেখানে বুকের পাটা লাগে, সেখানে রবাহুত, অনাহুত হিসেবে বিদেশে যাওয়া, ভিসা ছাড়া পরের দেশে ঢোকা, ধৈর্য্যে বুক বেঁধে সুদিনের অপেক্ষা করার জন্য কতোটা বুকের পাটা লাগে, একবার ভেবে দেখুন৷

Deutsche Welle DW Arun Chowdhury
অরুণ শঙ্কর চৌধুরী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

স্বর্গ হতে বিদায়

তাই আমার এই সাহসী ভাইদের আমি শুধু বিচার করে দেখতে বলব: ইউরোপে হাওয়া যে বদলাচ্ছে, খোদ ইউরোপ যে বদলাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ ব্রেক্সিট, গোটা ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থি, জাতীয়তাবাদী পপুলিস্টদের পালে হাওয়া, এ সব ভালো লক্ষণ নয় – কিন্তু স্বাভাবিক, যেমন জোয়ারের পর ভাটা৷ আমার মন বলছে, ইউরোপ এবার ঘরে আগল দেবে; ইউরোপ আর আগের মতো বিদেশি-বহিরাগতদের সাদরে, সস্নেহে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করবে, ইউরোপের মনে যেন কোথায় শঙ্কা ঢুকে গেছে৷

বদান্যতা কোনো মানুষ কিংবা জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, তা আসে অবস্থা ও পরিস্থিতি থেকে৷ ঔপনিবেশিক ইউরোপের মতোই উদার ইউরোপ, দরাজ ইউরোপের দিন যেতে বসেছে৷ এ অবস্থায় যারা দেশঘর ছেড়ে এ মুলুকে আসবেন, তাদের মনে রাখতে হবে, এককালে ইউরোপ আসাটা ছিল বুড়ি ছোঁয়ার মতো, একবার পৌঁছতে পারলেই নিশ্চিন্দি৷ এখন কিন্তু জার্মানিতে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, সেটি হলো ‘ব়্যুকফ্যুহরুং', যার অর্থ প্রত্যাবর্তন বা ফেরত পাঠানো৷

স্বর্গে আসা খুবই কষ্টের, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে আসতে হয়৷ তবে তার চেয়েও বেশি কষ্ট কীসে জানেন? স্বর্গ থেকে বিদায় নেওয়া৷ ঈশ্বর করুন তা যেন কারো ভাগ্যে না জোটে৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷