আন্তর্জাতিক শান্তিচিহ্নের ৬০ বছর
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যে প্রতীকটি সৃষ্টি হয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে, তা আজ সব ধরনের সহিংসতা, দ্বেষ ও নিপীড়নবিরোধী প্রতীকে পরিণত হয়েছে৷
শান্তির জন্য প্রথম ইস্টার মিছিল
১৯৫৮ সালের ইস্টারে ব্রিটেনে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ চলে, তার লোগো হিসেবে ব্রিটেনের গ্রাফিক শিল্পী জেরাল্ড হল্টম শান্তি প্রতীকটি তৈরি করেন৷ নৌবাহিনীর সেমাফোর পদ্ধতিতে আঁকা ‘এন’ ও ‘ডি’ অক্ষরগুলির অর্থ হল ‘নিউক্লিয়ার ডিজআর্মামেন্ট’ বা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ৷ সেবার দশ হাজার মানুষ লন্ডন থেকে অল্ডারম্যাস্টনের পারমাণবিক সমরাস্ত্র কেন্দ্র অভিমুখে পদযাত্রা করেন৷
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ষাটের দশকে বিশ্ব জুড়ে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিয়েতনামে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তখন তাঁরা হল্টমের প্রতীকটিকেই বেছে নেন৷ সান ফ্রান্সিস্কোর কেজার স্টেডিয়ামে ভিয়েতনাম যু্দ্ধবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশের একটি দৃশ্য: বিক্ষোভকারীদের অনেকেই যুদ্ধবিরোধী প্রতীক চিহ্নটি পরেছেন৷
ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যরাও যে প্রতীকটি বেছে নিয়েছিলেন
শুধু হিপি বা শান্তি আন্দোলনকারীরাই নন, যুদ্ধাঞ্চলে খোদ মার্কিন সৈন্যরাও তাদের হেলমেটের উপর যুদ্ধবিরোধী চিহ্নটি এঁকে নিতেন অথবা ঐ চিহ্ন আঁকা পতাকা ওড়াতেন৷ উদ্দেশ্য একই: যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো৷
‘মেক লাভ, নট ওয়ার!’
‘যুদ্ধ নয়, প্রেম!’ এই স্লোগান দিয়েই বিটলস খ্যাত জন লেনন ও তাঁর স্ত্রী ইওকো ওনো ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান ঘোষণা করেন৷ প্যারিসের একটি হোটেলের কামরায় বিছানায় শুয়ে দু’জনের ‘বেড-ইন’ প্রতিবাদ ষাটের দশকের শেষে সারা দুনিয়ার শান্তি আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করে৷ ১৯৭১ সালে বেরোয় লেননের সুবিখ্যাত শান্তি গীত ‘ইম্যাজিন’৷ ইওকো ওনো আজ অবধি বিভিন্ন শান্তি ও মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত৷
যে জাহাজের নামে ‘গ্রিনপিস’
ক্যানাডার একদল পরিবেশ সংরক্ষণকারী ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অ্যালাস্কার উপকূল থেকে ‘গ্রিনপিস’ জাহাজটিতে চড়ে আমচিটকা দ্বীপ অভিমুখে যাত্রা করেন৷ উদ্দেশ্য, একটি মার্কিন পরীক্ষামূলক আণবিক বিস্ফোরণ রোখা৷ এই প্রতিবাদের ফলে সারা বিশ্বে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐ ধরনের পরীক্ষামূলক আণবিক বিস্ফোরণ বন্ধ করে৷ অপরদিকে ‘গ্রিনপিস’ জাহাজটির নামে গ্রিনপিস পরিবেশ সংগঠন জন্ম নেয়৷
শান্তির প্রতীক কখনো পুরনো হয় না
যুদ্ধবিরোধীরা আজ অবধি হল্টমের শান্তিচিহ্নটি ব্যবহার করে চলেছেন, ২০০৬ সালে বুদাপেস্টের হিরোজ’ স্কোয়ারে আলোকবর্তিকা দিয়ে সৃষ্টি এই সুবিশাল প্রতীক যার প্রমাণ৷ উপলক্ষ্য ছিল, ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রদর্শন৷
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শান্তির প্রতীক
হল্টমের শান্তিচিহ্ন সন্ত্রাসবাদের যুগে নতুন অর্থ পেয়েছে ও প্রেরণা জুগিয়েছে৷ ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসে সন্ত্রাসী আক্রমণের পর ফরাসি গ্রাফিক শিল্পী জঁ জুলিয়্যাঁ শান্তিচিহ্নের মাঝখানে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের আভাস দিয়ে এই ছবিটি আঁকেন, যা অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ও নানা শোক সমাবেশে প্রদর্শিত হয়৷
শস্যক্ষেতে শান্তিচিহ্ন
২০১৭ সালে জার্মানির বন শহরে জি-টোয়েন্টি শীর্ষবৈঠকের সময় লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের এক খামারচাষি তাঁর শস্যক্ষেতে ট্রাক্টর দিয়ে শান্তিচিহ্নটি কাটেন, আকাশ থেকে যা দেখা সম্ভব ছিল৷ যেহেতু হল্টম তাঁর অঙ্কণটির কপিরাইট নেননি, সেহেতু যে কেউ এই প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করতে পারে৷
শান্তিচিহ্ন ও ইস্টারের মিছিল
প্রথমটি বিশ্বব্যাপী, কিন্তু দ্বিতীয়টি জার্মানির এক নিজস্ব ধারা:৷ ১৯৬০ সালে তথাকথিত ঠান্ডা লড়াই যখন চরমে উঠেছে, তখন জার্মানিতে প্রথম ইস্টারের শান্তি মিছিলটি হয়৷ আবার ঠিক সেই বছরেই হল্টমের শান্তি প্রতীকের জন্ম৷ ছবিতে ২০১৭ সালের ইস্টারে মিউনিখ শহরে এক মহিলা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাচ্ছেন; পাশের আন্দোলনকারীর হাতে হল্টমের শান্তিচিহ্ন আঁকা পতাকা৷