আন্তঃদেশীয় বিচারে ভিডিও কনফারেন্স
২৪ জুন ২০১৮নেহার বাড়ি যশোরে৷ সেখান থেকে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মুম্বইয়ে ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছিলেন নেহা৷ যশোর মানবপাচারের অন্যতম প্রধান রুট৷
নেহা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমি ভিডিওতে আমাকে পাচার করা ব্যক্তিদের দেখেছি, এবং তাদের শনাক্ত করতে মোটেও ভয় পাইনি৷ আমি নিশ্চিত ছিলাম বারের পেছনেই তাদের দেখতে পাবো৷''
নেহা যশোরেই একটি বিউটি পার্লার চালান এখন৷ অথচ তাকে যখন ভারতের যৌনপল্লী থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তখন তিনি পাচারকারীদের শনাক্ত করতে ভীত ছিলেন৷ এমনকি ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মিথ্যাও বলেছেন, পাছে আবারও পাচারকারীরা ক্ষতি করে সেই ভয়ে, পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কথা চিন্তা করে৷
মানবপাচারকারীরা কাজের নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ ও নেপালে গরিব পরিবারের মেয়েদের ভারতে নিয়ে যায়৷ পরে যৌন ব্যবসায় জড়াতে বাধ্য করে৷
জোর করে যৌন ব্যবসায়ে জড়ানোর পেছনে যারা আছে, তাদের শনাক্ত করতে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সাহায্য নেওয়া একটি যুগান্তকারী ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন সেবাকর্মীরা৷
মানবপাচার প্রতিরোধে কাজ করা সেবাকর্মীরা বলছেন, এর ফলে অপরাধীরা সহজেই সাজা পাবেন এবং তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে৷ ২০১৬ সালে এরকম এক অপরাধীকেই ধরে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল৷ তখন ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমেই অপরাধীকে আদালতের সামনে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া চলেছিল৷
এ ধরনের অপরাধের বিচার হয় মূলত ভারতের আদালতেই৷ তার মানে হচ্ছে অভিযোগকারীকে বিচার চলাকালীন দীর্ঘ সময় সেদেশেই নিরাপত্তা হেফাজতে থাকতে হয়৷
জোর করে যৌন ব্যবসায় জড়িত হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে কাজ করে যাচ্ছে ভারতের দাতব্য সেবা প্রতিষ্ঠান রেসকিউ ফাউন্ডেশন৷ সংস্থাটির কৌঁসুলী শাইনি পাডিয়ারা বলেন, ‘‘উদ্ধারের পর ভুক্তভোগীরা সবসময়ই তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে উতলা হয়ে দেশে ফিরতে চান এবং অপরাধীদের শনাক্তের জন্য আর কখনোই ফেরত আসেন না৷''
তিনি জানান, ভিডিও কনফারেন্সিং এই প্রক্রিয়া সহজ করেছে৷ অপরাধী সনাক্ত এবং ভুক্তভোগীদের বয়ান নিতে আরও অন্তত ১০টি এমন ঘটনায় বাংলাদেশ থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘ভিডিও কনফারেন্সিং-এর এই ব্যাপারটি পুরোদমে চালু হলে অপরাধীদের বেকসুর খালাস পাওয়ার হার অনেক কমে যাবে৷''
তাছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করে ভুক্তভোগীদের অপরাধী পক্ষের উকিল যে নাজেহাল করেন, তার পরিমাণও কমে আসবে৷ যেমনটি মালদারের ক্ষেত্রে হয়েছিল, বিরোধী উকিলের তিন ঘণ্টা জেরায় অতিষ্ঠ হয়েই এক সময় তিনি নিজের পরিচয় সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিলেন৷
মাগুড়ার তারা খোকন মিয়া, তার ২৭ বছর বয়সি মেয়েকে প্রস্তুত করছেন ঢাকায় বসে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে ভারতে সাক্ষী দেওয়ার জন্য৷
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আমি আমার মেয়েকে চিরজীবনের জন্য হারিয়েই ফেলেছিলাম৷''
খোকন মিয়ার মেয়ে গার্মেন্টস কর্মী৷ ভারতে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে পাচার করা হয়৷ সেখানে একবছর আটকে রেখে তার ওপর চলে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং মারধর৷ প্রায় এক বছর পরে উদ্ধার হয় মেয়েটি৷
খোকন মিয়া বলেন, ‘‘তারা যা করেছে ক্ষমার অযোগ্য৷''
এ ঘটনার আইনি প্রক্রিয়া ২০১৩ সাল থেকে চলছে৷ যশোরের একটি সমাজসেবা সংগঠন এ ব্যাপারে সহায়তা করছে৷ সবচেয়ে ভালো দিক হলো মেয়েটির সাথে তাঁর পরিবার সহযোগিতা করছে৷
ভারত বাংলাদেশের সাথে ২০১৫ সালে এবং নেপালের সাথে ২০১৭ সালে মানবপাচারের অপরাধগুলোর দ্রুত বিচার নিয়ে চুক্তি করে৷
যশোরের বিচারক কে এম মামুন বলেন, ‘‘ভিডিও কনফারেন্সিং-এর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বচ্ছ৷ আমি সাধারণত উপস্থিত থাকি এবং ভুক্তভোগীরা খুব সহজেই অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারে৷''
পুরো প্রক্রিয়াটি গোপনে চলে বলে ভুক্তভোগীরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন৷
তবে ভিডিও কনফারেন্সিং করে এরকম বিচারের একটি সমস্যা হলো ইন্টারনেট সংযোগের দুর্বল অবস্থা৷ মাঝে মাঝেই সংযোগ দুর্বল হলে দু'দেশের মধ্যে এটি বন্ধ হয়ে যায়৷
অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম একটি সংগঠন রাইটস৷ তাঁরা বিচারে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করছেন৷ তার প্রধান বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, কোনো কোনো সময় ইন্টারনেট সংযোগ খুব খারাপ থাকে এবং শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়৷'' তবে এটি কাটিয়ে উঠতে পারলে ভিডিও কনফারেন্সিং বিচারের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হতে পারে৷
২০১০ সালে প্রযুক্তি ও ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবহার করে স্বাতী চৌহান বিচারক হিসেবে প্রথম এ ধরনের একটি মামলার রায় দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ভুক্তভোগীরা এ সব ক্ষেত্রে মানসিক ট্রমায় ভোগেন৷ তারা অনেক সময়ই পাচারকারীদের মুখোমুখি হতে চান না৷ তার মানে এই নয় তারা পাচারকারীদের শাস্তি চান না৷''
‘‘একটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া চালানো যদিও সহজ নয়৷ কেননা অনেকগুলো সরকারি বিভাগ এবং দু'দেশের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়৷ তবে এটিই ভবিষ্যতে অনেক ন্যায়বিচারের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে৷''
অনুরুদ্ধ নাগারাজ/এইচআই
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো বন্ধু? জানান নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷