1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আত্মঘাতী হামলা, আত্মঘাতী জঙ্গি

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১০ এপ্রিল ২০১৭

বাংলাদেশে জঙ্গিদের আত্মঘাতী প্রবণতা সাম্প্রতিক৷ গত জুলাই মাসে ঢাকার হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পর, জঙ্গিবিরোধী অভিযান তীব্র হলে এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ জঙ্গিরা একাধিক আত্মঘাতী হামলা চালায়, হয় আত্মঘাতী৷

https://p.dw.com/p/2av9e
Bangladesch Terror-Anschlag gegen Kontrollpunkt der Polizei in Dhaka
ছবি: Getty Images/AFP/STRINGER

জঙ্গিদের সুইসাইড গ্রুপ বাংলাদেশে নতুন হলেও সারা বিশ্বে এর অনেক নজির আছে৷ আল-কায়েদা থেকে তথাকথিত ইসলামিক স্টে (আইএস) – সব জঙ্গি গ্রুপেরই আত্মঘাতী হামলার রেকর্ড আছে৷ আত্মঘাতী হামলাকারীরা নিজেরা মরে ব্যাপক হত্যা বা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চায়৷ এমনকি আত্মঘাতী হামলার মধ্য দিয়ে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যাচেষ্টার নজিরও আছে৷ আত্মঘাতীরা তাদের শরীরে বিস্ফোরক ভর্তি বোমা বেধে নিজেরাই একটি ধ্বংসাত্মক ডিভাইসে পরিণত হয়৷ পরে সেই বোমার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে টর্গেটের লোকজনকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও নিহত হয়৷ ফলে এই প্রবণতা সবচেয়ে ভীতিকর এবং ধ্বংসাত্মক৷ সাধারণভাবে তাদের ঠেকানো খুবই কঠিন৷ এ কারণে বাংলাদেশে এই আত্মঘাতী জঙ্গিরাই এ মুহূর্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যাথার প্রধান কারণে পরিণত হয়েছে৷

বাংলাদেশে নব্য জেএমবি-র সদস্যদের মধ্যে সম্প্রতি আত্মঘাতী প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও, আগেও এর নজির ছিল৷ ২০০৫ সালের ২৯শে নভেম্বর ঢাকার অদূরে গাজীপুরে প্রথম আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে৷ এই হামলায় আত্মঘাতী হামলাকারী জেএমবি-র সদস্য আসাদসহ আটজন নিহত হয়৷

Sanoar Hossaian - MP3-Stereo

পুলিশ জানায়, গত বছরের ১লা জুলাই হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর, ২৫শে ডিসেম্বর ঢাকার আশকোনায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় ধরা না দিয়ে শরীরে থাকা সুইসাইডাল ভেস্ট-এর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ও পিস্তলের গুলিতে আত্মঘাতী হয় তানভীর কাদেরীর ছেলে আফিফ কাদেরী এবং শাকিরা নামে নব্য জেএমবি-র এক নারী সদস্য৷ সেই থেকেই শুরু৷

এরপর চলতি বছরের ১৬ই মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানা ‘ছায়ানীড়'-এ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে' নারীসহ চারজন নিহত হয়

১৭ই মার্চ ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছে র‌্যাবের নির্মাণাধীন ভবনের ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে এক জঙ্গি নিহত হয়৷

তার ঠিক একদিন পর, অর্থাৎ ১৮ই মার্চ, খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের অস্থায়ী চেকপোস্টে হামলার চেষ্টা করে নিহত হয় আরেক আত্মঘাতী জঙ্গি: তার ব্যাগ থেকে বোমা ও সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করা হয়৷

২৪শে মার্চ শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার গোলচত্বরে পুলিশ চেকপোস্টের কাছে এক আত্মঘাতী জঙ্গি নিহত হয়৷ পুলিশ আরো দাবি করে যে, সিলেটের শিববাড়িতে জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল'-এ ২৩শে মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ পর্যন্ত অভিযানের সময় ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে' এক নারীসহ চারজন জঙ্গি নিহত হয়৷

২৮শে মার্চ থেকে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে ‘অপারেশন হিট ব্যাক'-এ আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয় নব্য জেএমবি-র অন্যতম শীর্ষ নেতা দিনাজপুরের লোকমান হোসেন, তার স্ত্রী শিরিনা আক্তার এবং তাদের পাঁচ মেয়ে৷ এদের মধ্যে চারজন শিশু৷ পুলিশ বলছে, শিশুদের মাঝখানে রেখে তারা বিস্ফোরণ ঘটনায়৷

DR Sohel Mahmud - MP3-Stereo

৩১শে মার্চ থেকে ১লা এপ্রিল মৌলভীবাজারের বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস'-এর সময় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুই পুরুষ ও এক নারী নিহত হয়৷

পুলিশের কথায়, যারা আত্মঘাতী হয়েছে তাদের অধিকাংশই ছিল সুইসাইডাল ভেস্ট পরা৷ কোমরে বাধা এই ভেস্টে বোমা এবং বিস্ফোরক ভরা থাকে৷ এরা আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে হত্যা ছাড়াও ধরা না দিতে আত্মঘাতী হয়৷ এর উদ্দেশ্য হলো, যাতে ধরা পড়লে তথ্য ফাঁস হয়ে না যায়৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গিদের সুইসাইডাল বা আত্মঘাতী যেসব ভেস্ট উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো হাতে তৈরি৷ একটি ভেস্টে কমপক্ষে পাঁচটি করে হাতে তৈরি গ্রেনেড রেখে একযোগে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়৷

বাংলাদেশে বর্তমানে জঙ্গি বিষয়ক প্রতিবেদন করে আলোচিত এবং ‘হোলি আর্টিজান একটি জর্নালিস্টিক অনুসন্ধান' বইয়ের লেখক সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হোলি আর্টিজানের পর ২৫শে ডিসেম্বর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় এক নারী সুইসাইডাল ভেস্ট পরে পুলিশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং বিস্ফোরণে নিহত হয়৷ এরপর এ রকম আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে৷ আমাদের হিসেবে এ ধরনের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১০-১২ জন নিহত হয়েছে৷''

তাঁর মতে, ‘‘হামলা ছাড়াও পুলিশি অভিযানের সময় জঙ্গি আস্তনাগুলোতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়৷ আর অভিযানের পর দেখা যায় এদের কোমর উড়ে গেছে, পাশে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন ভেস্ট৷ এর থেকে পুলিশ নিশ্চিত হয় কারা আত্মঘাতী৷ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের রেফারেন্সও তারা ব্যবহার করে৷''

নুরুজ্জামান লাবু আরও জানান, ‘‘সর্বশেষ সিলেটের নাসিরপুরে সার্জিক্যাল ভেস্টও পাওয়া গেছে৷ সাধারণ সুইসাইডাল ভেস্টে একটি বেল্টের সাথে ৪-৬টি স্থানীয়ভাবে তৈরি গ্রেনেড থাকে৷ একটা সুইচ দিয়ে যার বিস্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতীরা৷ অন্যদিকে সার্জিক্যাল ভেস্টে একসঙ্গে বিস্ফোরক ভরা থাকে এবং ডেটোনেটর দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়৷''

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক-এর চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ বেশ কয়েকজন আত্মঘাতী জঙ্গির ময়নাতদন্ত করেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘এদের কোমরের দিক থেকে ওপরের অংশ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়৷ কোমরে বিস্ফোরকের ভেস্ট বেঁধে রাখায় এই পরিসিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ বিস্ফোরণে দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়৷ তাই তাদের শরীরেও বিস্ফোরকের আলামত পাওয়া যায়৷’’

যারা আত্মঘাতী হয়েছে, তাদের মধ্যে নারীরাও আছে৷ তবে তারা বয়সে তরুণ৷ এদের জন্য রয়েছে মোটিভেশন প্রক্রিয়া৷ কাউন্টার টেরররিজম ইউনিটের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মহিবুল ইসলাম জানান, ‘‘আমরা হোলি আর্টিজানের পর এ পর্যন্ত বড় ধরনের ১১টি অভিযান পরিচালনা করেছি৷ তারপরও দেশে এখনো কিছু আত্মঘাতী জঙ্গি আছে বলে মনে হয়৷ অবশ্য তারা সংখ্যায় খুব বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে না৷''

 

তিনি আরও বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের যে চরিত্র, তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে৷ আত্মঘাতী জঙ্গিদের সেভাবেই মোটিভেট করা হয়৷''

Nuruzzaman Labu - MP3-Stereo

পুলিশের দাবি, জঙ্গিরা অভিযানের মুখে কোণঠাসা হয়ে পরার কারণে এখন আত্মঘাতী হচ্ছে৷ কারণ এখন তারা চাইছে, এদের তথ্য যেন ফাঁস না হয়৷ আত্মঘাতী হামলার চেয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ধরে রাখা ও তথ্য গোপন করার জন্যই ধরা পরার আগে আত্মাহুতি দিচ্ছে এরা৷ কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জঙ্গিদের আলাদা সুইসাইড স্কোয়াড আছে কিনা, সে বিষয়টি নিশ্চিত নই আমরা৷ তবে তাদের কাজের নানা ভাগ আছে৷ কারা আক্রমণে থাকবে, কারা সহযোগিতা করবে – তা সাধারণত ভাগ করা থাকে৷ আমাদের ধারণা, এদের মধ্য থেকেই একটি গ্রুপকে মোটিভেট করা হয় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী হিসেবে৷''

ছানোয়ার বলেন, ‘‘এটা তাদের একটা নতুন কৌশল৷ কারণ অতীতে তাদের নেতারা ধরা পরার পর তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অরো অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে৷ তাই তারা এখন ধরা পড়ার আগেই আত্মঘাতী হচ্ছে, যাতে সংগঠন এবং অন্যান্যরা নিরাপদ থাকে৷''

বলা বাহুল্য, জঙ্গিরা যদি ক্রমশ আত্মঘাতী হামলার দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তা হবে ভয়ংকর৷ তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে তা হলো, বাধা পেয়ে, তল্লাশী বা অভিযানের মুখে পড়েই বাংলাদেশে জাঙ্গিরা আত্মঘাতী হচ্ছে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘এই আত্মঘাতীরা ভীষণভাবে মোটিভেটেড৷ তাই তারা যদি টার্গেট অনুযায়ী আত্মঘাতী হামলা শুরু করে, তবে তা হবে ভয়াবহ৷''

তাঁর কথায়, ‘‘আত্মঘাতী হামলা ঠেকানো কঠিন৷ তাই প্রয়োজন এর বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক ডিব়্যাডিকালাইজেশন প্রক্রিয়া৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য