1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অভিভাবকত্ব আইনের বার্ধক্যকাল উপনীত

২২ জুলাই ২০২২

নানা পারিবারিক ও সামাজিক কারণে বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে৷ সরকারি হিসেব মতে, রাজধানী ঢাকা শহরে ২০২০ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল ৯ হাজার ৭৮৭টি আর ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৯১৯টি৷

https://p.dw.com/p/4EV02
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয়
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয়ছবি: Mortuza Rashed/DW

করোনা মহামারীর সময় ঢাকা শহরে দৈনিক ৩৯টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছিল৷ অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে৷ বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ায় এই সময়ে সন্তানের অভিভাবকত্বের বিষয়টিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হয়েছে৷ অভিভাবকত্বের অধিকারের জন্য পিতা-মাতার মধ্যকার আইনি লড়াইয়ের খবর সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে৷ এসব আলোচনায় অভিভাকত্বের আইনি পরিধিতে ভারসাম্যহীনতার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে৷

আইনের ভাষায় নাবালক, নির্বোধ ও উন্মাদ-যারা নিজের দেখাশোনা নিজে করতে পারে না, তাদের হেফাজত বা তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা বা অধিকার হলো অভিভাবকত্ব৷ বাংলাদেশে শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব মুসলিম শরীয়া আইন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং অভিভাবক এবং প্রতিপালন আইন, ১৮৯০ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তানকে নাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ আর ওই সন্তানের অভিভাবক হলেন তিনি, যিনি ওই সন্তানের শরীর কিংবা সম্পত্তি অথবা উভয়ের তত্ত্বাবধান ও ভরণপোষণে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত৷ এসব আইনে সন্তানের তত্ত্বাবধান বা হেফাজত এবং অভিভাবকত্ব আলাদা আলাদাভাবে দেখা হয়৷

বাংলাদেশে প্রচলিত এসব আইন অনুযায়ী পিতাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক আর মা হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক৷ সন্তানের মা যদি বাবার কাছ থেকে আলাদা থাকেন কিংবা তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাহলে মা তার সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারাবেন না৷ ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের বয়সন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন৷ তবে সন্তানকে মায়ের হেফাজতে দিলেও আইনানুযায়ী ভরণপোষণ পিতাকেই বহন করতে হয়৷ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রচলিত আইনগুলোতে সন্তানের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বের আইনগত অধিকার নিয়ে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে৷ এই ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেক ধরনের বিপত্তি দেখা দিচ্ছে৷ বিশেষ করে বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে দিনের পর দিন এসব মামলাগুলো ঝুলছে৷ বাংলাদেশের হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ হলো, ২০০৮ সাল থেকে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলো ঝুলে আছে এবং আদালত ছয় মাসের মধ্যে এসব মামলা পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছিলেন৷

অভিভাবকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে আইনে যা থাকুক না কেন আইন ও আদালতের কাছে এক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো নাবালক বা শিশুর স্বার্থ ও কল্যাণ৷ এজন্য বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের আদালতগুলো আইনের উর্ধ্বে উঠে রায় দিয়েছেন৷ ২০১৮ এপ্রিলে আদালতের রায়ে একমাত্র মেয়ের অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন অভিনেত্রী বাঁধন৷ আদালত এই রায়ে বলেছিলেন, মা-ই কন্যাশিশুর অভিভাবক৷ ২০১৯ সালের নভেম্বরে আরেক মামলার রায়ে আদালত বলেছিলেন, তিন বছর বয়সী শিশুসন্তানকে বাবা সপ্তাহে একদিন (১২ ঘণ্টা) নিজের কাছে রাখার সুযোগ পাবেন৷ আবার বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানেও সেই সন্তানকে কাছে পাবেন বাবা৷ ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর দেয়া আরেক মামলার রায়ে আদালত সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে বিশেষত শিশুসন্তানের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ওই মামলাটি (পারিবারিক আদালতে শিশুর মায়ের করা মামলা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশু সন্তানটিকে বাবার হেফাজতে থাকার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন৷ বাংলাদেশের মত ভারতেও আদালতের এমন কিছু ব্যতিক্রমী নির্দেশ আছে৷

সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনগুলো বেশ পুরানো৷ আইনগুলো যখন প্রণীত হয় তখন সে সময়ের সামাজিক বাস্তবতায় হয়তো সেগুলো ঠিক ছিল৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে৷ ২০২২ সালের জুলাইয়ে কেরালা হাইকোর্ট এক রায়ে জানিয়েছিলেন, কোরান কিংবা হাদিসে একজন মুসলিম নারীর সন্তানের অভিভাবক হওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রে কোন বাধা না থাকলেও আইনানুযায়ী একজন মুসলিম নারী তার নাবালক সন্তান এবং সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারেন না৷ আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, আধুনিক যুগে নারীরা অনেক এগিয়েছেন৷ অনেকেই প্রায় পুরুষদের কাজের সঙ্গে সমান সমান টক্কর দেন৷ এছাড়াও বহু ইসলামিক দেশ কিংবা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীরা রয়েছেন৷ মহাকাশ মিশনে অংশগ্রহণ করছেন মহিলারা৷ কিন্তু আইন এখনও নারীদের সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ ও অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সমানাধিকার দিচ্ছে না৷

যুগের দাবির কারণে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবার জ্ঞান ও অনুমতি ছাড়া মা সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে পারেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তরে একটি অভূতপূর্ব রায় ঘোষণা করেছিলেন৷ রায়ে বিচারকেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিভাবকত্ব আইন বিবেচনা করে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের কল্যাণকে একজন উদাসীন পিতার অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে একক জননী অথবা অবিবাহিত মাকে সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষমতা দিয়েছিলেন৷

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত আইনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতিহ্যগতভাবে মায়েদের সবসময় বাবার চেয়ে একটি সন্তানের উপর বেশি অধিকার থাকে৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পরে শিশুদের জন্য জীবনযাত্রার ব্যবস্থা পরিচালনাকারী হেফাজত আইনগুলো নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে৷ বাবা-মা'র বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের যৌথ হেফাজত ও অভিভাবকত্বের বিষয়টির আইনগত স্বীকৃতি খুব বেশি দিনের নয়৷ এই স্বীকৃতি প্রথম মিলে সুইডেনে ১৯৭৬ সালে৷ এখনও বিশ্বের খুব কম দেশেই বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর যৌথ হেফাজতে (শেয়ারড কাস্টডি) সন্তানের থাকার বিধান আছে৷ যেসব দেশে যৌথ হেফাজতের বিধান আছে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম অন্যতম৷ এর মধ্যে কানাডার আইন যৌথ হেফাজত (জয়েন্ট কাস্টডি) শব্দটি ব্যবহার না করে যৌথ অভিভাবকত্ব (জয়েন্ট প্যারেন্টিং) শব্দটি ব্যবহার করে৷

বাংলাদেশে যেমন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয় ঠিক উল্টোভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে বাবাকে এমন অধিকারের দাবিতে আদালতে ঘুরতে হয়৷ এজন্য পশ্চিমা অনেক দেশে বাবাদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হয়েছে, গড়ে উঠেছে ফাদারস রাইটস মুভমেন্ট নামে সামাজিক আন্দোলন৷ যেমন অস্ট্রেলিয়াতে ফাদারস রাইটস গ্রুপের অনেকদিনের আন্দোলেনর প্রেক্ষিতেই ২০০৬ সালে দেশটির পারিবারিক আইন সংশোধন করে সন্তানের যৌথ হেফাজতের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ বাবাদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ফ্রান্সে ১১৭টি যারা সন্তানের যৌথ হেফাজতের জন্য আন্দোলন করেছে৷

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

দেখা যাচ্ছে, বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের হেফাজত বা তত্ত্বাবধান এবং অভিভাবকত্ব নিয়ে দেশভেদে আইন ও নিয়মকানুনের ভিন্নতা আছে৷ এ নিয়ে ইতিমধ্যে একাডেমিক পর্যায়ে বেশি কিছু গবেষণা হয়েছে৷ সেসব গবেষণা এবং বিভিন্ন রায়ের ক্ষেত্রে আদালতের দেয়া পর্যবেক্ষণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এসব আইনের ভিন্নতার কারণ বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট৷ যে কোন আইন-ই অধিকার থেকে জন্ম নেয়৷ সমাজে একটি জিনিস মানুষ প্রথম নৈতিকভাবে দাবি করে৷ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ নৈতিক দাবিটিকে যখন আইনি ভিত্তি দেয় তখন সেটি হয়ে ওঠে আইনগত অধিকার৷

প্রতিটি সমাজকেই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ পরিবর্তন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থা অচল৷ সে হিসেবে আইনেরও একটি স্বাভাবিক বিবর্তন প্রক্রিয়া আছে যাকে অর্গানিক প্রসেস বা জৈব প্রক্রিয়া হিসেবে তাত্ত্বিকেরা ব্যাখ্যা করেছেন৷ এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আইন হলো জীবন্ত শরীরের মত৷ সময়ের সাথে সাথে তার শৈশব আসে, যৌবন অতিক্রান্ত হয়ে বার্ধক্য আসে এবং মৃত্যুও ঘটে৷ এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া আইনগুলো তাই সার্বজনীন হয় না৷ সমাজের চাহিদা ও বিবর্তনের ভিন্নতার জন্য আইনি ব্যবস্থার ভিন্নতাও আমরা লক্ষ্য করি৷

স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন কারণে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সন্তান কার কাছে থাকবে বা কে হবেন তাদের অভিভাবক- এই প্রশ্ন দেখা দেয়৷ সন্তান কার জিম্মায় থাকবে তা নিয়ে শুরু হয় টানাহ্যাঁচড়া৷ এই টানাহ্যাঁচড়ার ইতি টানার জন্য বিশ্ব্যবাপী আইনি সমাধানগুলোর বেশিরভাগের বয়স শতাব্দীকাল পেরিয়ে গেছে৷ বর্তমান আর্থ-সমাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এখন অনেক দেশই এগুলোকে অচল বলে ঘোষণা করে নতুন আইন ও বিধান সংযোজন করেছে৷ কোথাও বাবাকে সমান অধিকার দেয়া হচ্ছে, কোথাও মাকে৷ এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হচ্ছে, সন্তানের প্রতি বাবা-মা উভয়ের রয়েছে অধিকার৷ তাদের ভালোবাসা অসীম, ভালোবাসার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ভাষায় তুলে ধরার উর্ধ্বে৷ এ কারণে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সন্তানের যৌথ হেফাজতের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ কারণ এতে একটি শিশু বাবা-মা উভয়ের প্রভাব নিয়ে বড় হতে পারে৷ যৌথ আইনি হেফাজতে থাকা বাবা-মা সন্তানের জীবনের জন্য পারস্পরিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং সন্তানের লালনপালনে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেন৷ ইউনিভার্সিটি অব ইনসব্রাকের অধ্যাপক মার্টিন হেল্লা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, সন্তানের যৌথ হেফাজত আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার হার কমাতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে৷ তিনি বলেছেন, বিবাহবিচ্ছেদ এখন বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক প্রপঞ্চে পরিণত হয়েছে৷ তাই আমাদের শিশুদের ভবিষ্যত মঙ্গলের কথা চিন্তা করে যৌথ হেফাজতকে যতটা সম্ভব উৎসাহিত করা উচিত৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান