অবিস্মরণীয় চার্লি চ্যাপলিন

কালো মোচ, কালো টুপি, হাতে বেত, পায়ে অতি পুরনো বুটজুতো আর পাতিহাঁসের মতো চলন – দেখলেই মানুষজন বুঝবেন, হয় চ্যাপলিন, নয়তো চ্যাপলিনের নকল৷ চ্যাপলিন তাঁর ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে চরিত্রে প্রথম আবির্ভূত হন ১৯২১ সালে, ‘দ্য কিড’ ছবিতে৷ হাসিঠাট্টা আর বিষণ্ণতা, ভাঁড়ামো আর হতাশা মিলে এক অদ্ভুত রস সৃষ্টি হয়েছে এই অদ্ভুত চরিত্রটিতে৷

চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিনের জন্ম ১৮৮৯ সালে, খুব সম্ভবত লন্ডনে৷ তিনি পরলোকগমন করেন ১৯৭৭ সালে, সুইজারল্যান্ডে৷ দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম ও শৈশব, কাজেই চ্যাপলিন জানতেন, দারিদ্র্য ও হতাশার মধ্যে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার আশা ও স্বপ্ন৷ এর হাস্যকর দিকটা আবার ফুটে উঠেছে তাঁর ‘গোল্ড রাশ’-এর মতো ছবিতে (১৯২৫): একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে ঐশ্বর্য – ও সুখাদ্যের – স্বপ্ন৷

চ্যাপলিনের বহু ছবি নির্বাক ছায়াছবির যুগের৷ সাইলেন্ট ফিল্ম থেকে ‘টকিজ’-এ তাঁর উত্তরণ ১৯৩১ সালে, ‘সিটি লাইটস’ ছবিটিতে৷ তবে সবাক ছবি চ্যাপলিনের কোনোদিনই বিশেষ ভালো লাগেনি৷ তাই তিনি নির্বাক ছবি তৈরি চালিয়ে যান, আবার প্রয়োজনে সংলাপও ব্যবহার করেছেন৷ তবে তাঁর পেটোয়া ছিল তাঁর চোখমুখের অভিব্যক্তি, তাঁর হাঁটাচলা, যা পূর্বাপর চ্যাপলিনের ট্রেডমার্ক থেকে যায়৷

মহিলাদের হৃদয় জয় করতে চ্যাপলিনের জুড়ি ছিল না৷ কিন্তু তাঁর নিজের পছন্দ ছিল তাঁর চেয়ে অনেক কম বয়সের মহিলাদের – যা নিয়ে কেলেংকারিও কম হয়নি, দুর্নাম হয়েছে যেমন যুক্তরাষ্ট্রে, তেমনই চ্যাপলিনের স্বদেশ ইংল্যান্ডে৷ ছবিতে চ্যাপলিনের দ্বিতীয় স্ত্রী, টিনেজ অভিনেত্রী লিটা গ্রে চ্যাপলিনকে উভয়ের দুই সন্তানের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, ১৯৩১ সালে৷

সিনেমায় চ্যাপলিন যে চরিত্রগুলিতে অভিনয় করেছিলেন, আধুনিক পরিভাষায় তাদের বলে ‘আন্ডারডগ’ বা নীচের তলার মানুষ, নিজের বুদ্ধি ও চাতুর্যের উপর নির্ভর করে যাদের জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়৷ ‘আন্ডারডগ’ বলতে কিন্তু ‘লুজার’ বা হেরো বোঝায় না৷ হেরোকেই হিরো করে তুলেছিলেন চ্যাপলিন৷ আবার ‘মডার্ন টাইমস’-এর মতো ছবিতে (১৯৩৬) ফুটে উঠেছে ‘আধুনিক’ যন্ত্রসভ্যতা ও তার হৃদয়হীনতা সম্পর্কে চ্যাপলিনের সমালোচনা৷

১৯৪০ সালে মুক্তি পায় ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’, যে ছবিতে হিটলার ও নাৎসিদের খোলাখুলি ব্যঙ্গ করেছেন চ্যাপলিন৷ খোদ হিটলার নাকি ছবিটি একাধিকবার দেখেছিলেন৷ চ্যাপলিন অবশ্য পরে বলেছেন, নাৎসি বন্দিশিবিরের বিভীষিকার কথা জানা থাকলে তিনি ছবিটি করতে পারতেন না৷

‘লাইমলাইট’ ছবিটি প্রথম মুক্তি পায় লন্ডনে, ১৯৫২ সালে৷ এর স্বল্প আগে চ্যাপলিনের মার্কিন মুলুকে আসা নিষিদ্ধ হয়েছিল, তিনি কমিউনিস্ট ও ভ্রষ্টাচারি সন্দেহে – যুক্তরাষ্ট্র্রে তথাকথিত ‘ম্যাককার্থি আমলে’ যা বহু বুদ্ধিজীবীর কপালে জুটেছিল৷ ‘লাইমলাইট’ ছবিতে চ্যাপলিন মঞ্চাভিনেতা হিসেবে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন৷

চ্যাপলিন দশ বছর ধরে কোনো ছবি না করার পর, ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর ‘এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’ ছবিটি৷ মার্লন ব্র্যান্ডো ও সোফিয়া লোরেনের মতো তারকারা থাকা সত্ত্বেও ছবিটি বক্স অফিসে ফ্লপ করে৷ চ্যাপলিন তাঁর জীবনের শেষ দশকগুলি কাটিয়েছেন সুইজারল্যান্ডে – এই সময়ে শুধুমাত্র একবার যুক্তরাষ্ট্র্রে ফিরেছিলেন তিনি, ১৯৭২ সালে, একটি সাম্মানিক অস্কার গ্রহণ করার জন্য৷

ঠিক চ্যাপলিন নয়, তবে তাঁর সৃষ্ট সেই ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে চরিত্রটি বোধহয় বিজ্ঞাপনের জগতের প্রথম বেওয়ারিশ কিন্তু বিশ্বায়িত প্রতীক: কাজেই সব রকমের পণ্য বা বিজ্ঞাপনে চ্যাপলিনের মুখ দেখে অভ্যস্ত আমরা৷ কস্টিউম বল বা কার্নিভালে চ্যাপলিন সাজেন অনেকে – সার্কাসের ভাঁড়দের মধ্যে চ্যাপলিনের ছোঁয়া আজও সর্বত্র৷

কিংবদন্তির নায়ক, আবার নিজেই কিংবদন্তি বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে অনধিকার প্রবেশ করে শেষমেষ সেই ইতিহাস জুড়ে থাকা এই মানুষটি – নিজের স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা অতিক্রম করে কবে মহাকালের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন৷ চ্যাপলিন বিশেষজ্ঞ লিজা স্টাইন হাফেন যেমন বলেছেন, ‘‘চ্যাপলিন হলিউডের তারকা ছিলেন না, কারণ হলিউড তখন সৃষ্টিই হয়নি৷’’