বিদ্রোহী কবির জীবন আজও আমাদের পাথেয়
২৫ মে ২০১০‘ইসলাম বা হিন্দু, ধর্ম নিয়ে আমার মনে কোনরকম বিরোধ নেই৷ যে কোন ধর্মকে আমি সহ্য করতে পারি, পারিনা কেবল টিকি বা দাড়িকে ঘিরে ধর্মের কোলাহল৷' যে কবি এমন সোজা করে কথা বলতে পারেন, তিনিই তো লিখতে পারেন এমন পংক্তি যা বলে, ‘মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি/ টিকি দাড়ি নিয়ে আজও বেঁচে আছি/ বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি / এবার সব্যসাচী / যাহোক একটা তুলে দাও হাতে একবার মরে বাঁচি৷'
জন্ম ১৮৯৯ সালে, বর্দ্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে৷ গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জেমের কাজ শুরু করেন একেবারে কৈশোর শুরুতেই৷ কণ্ঠে সুর ছিল, তাই আজান দেওয়ার কাজ পারতেন চমত্কার৷ সেই সুরেলা কণ্ঠই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় গ্রাম্য যাত্রা বা ‘আলকাপ’-এর দলে৷ সেখানেই বিকশিত হতে থাকে কবি প্রতিভা৷ গান লেখার ক্ষমতা৷ এরপর চলে গেলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে যুদ্ধে৷ সেখান থেকে ফিরে এসে সাংবাদিকের পেশা নিলেন উজ্জ্বল তরুণটি৷ সুপুরুষ চেহারা, কণ্ঠে সবসময়ে সুর, বাঁশি বাজাতে দক্ষ, অভিনয়ে অকুতোভয় আর হৃদয়ে বিপ্লবের অনাবিল চেতনা৷
এই নজরুল, যিনি সে সময়ের সংস্কারাবদ্ধ সমাজকে বদলাতে তাঁর যাবতীয় প্রতিভা আর উদ্যোগ নিয়োগ করেছিলেন, তিনিই লিখলেন বাংলাভাষায় প্রথম বিদ্রোহের কবিতা, যা সোচ্চারে বলতে পেরেছিল ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন' কিংবা ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা/ করি মৃত্যুর সাথে গলাগলি, লড়ি শত্রুর সাথে পাঞ্জা৷'
শুধু কবিতা রচনাতেই নয়, অসামান্য প্রাণোদনা ছিল এই মানুষটির৷ জীবনের সব ছোটখাটো দিকে ছিল তাঁর প্রখর দৃষ্টি৷ ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করায় তাঁকে বহুবার জেলবন্দী থাকতে হয়েছে৷ সে সময়ে রচিত তাঁর ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী' গ্রন্থে উঠে এসেছে দরিদ্র ভারতবাসীর জীবনযন্ত্রণা৷ সমাজে যারা ব্রাত্য, যারা পিছিয়ে পড়া, যারা পদদলিত, তাদের জন্য ছিল নজরুলের বুকভরা মমতা৷
আর ছিল তাঁর গানের এক অন্যধারার গতি৷ ঊর্দু গজলকে বাংলায় এক ভিন্ন স্বাদে আর মাত্রায় জায়গা করে দিয়েছেন নজরুল ইসলাম৷ যেখানে তিনিই প্রথম এক নতুন পথ তৈরি করেছেন৷ প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন তিনি৷ তাঁর সঙ্গীত বাঙালির ভাবের ঘরের সম্পদই শুধু নয়, তাঁর সঙ্গীত বাংলা গানকে এক নতুন মর্যাদা দিয়েছে৷ যে উত্তরাধিকার আজও অম্লান হয়ে আছে আমাদের কাছে৷
মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে এক আশ্চর্য রোগে আক্রান্ত হন কবি৷ তাঁর বাকশক্তি চলে যায়, চলে যায় স্মৃতিও৷ সাতের দশকে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর সেদেশের সরকার তাঁকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানায়৷ জাতীয় কবির সম্মান দেওয়া হয় বিদ্রোহী কবিকে৷ সপরিবারে নজরুল ইসলাম চলে যান বাংলাদেশে৷ সেখানেই ১৯৭৬ সালে তাঁর প্রয়াণ৷ বিদ্রোহী কবির যাত্রা কখনও শেষ হয়না৷ হবেও না৷ মৃত্যু এক অবস্থান্তর মাত্র৷ নজরুল তাই আছেন এবং থেকে যাবেন তাঁর চিরকালীন সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন