1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারীরা ফসলের জন্য ক্ষতিকর!

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

‘নারীরা ফসলের মাঠে যেতে পারবেন না' – এমন ফতোয়া দিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন কুষ্টিয়ার এক মসজিদের ইমামসহ চারজন৷ তবে সেই ইমামের অনুসারীরা এখনও সক্রিয়৷ তাই এলাকার নারীরা বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না৷

https://p.dw.com/p/2pIkh
Bangladesch Reis Frauen Frau Rangpur
ছবি: AP

গত ৮ ডিসেম্বর (শুক্রবার) জুম্মার নামাজের পর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কল্যাণপুর জামে মসজিদে এক বৈঠকে নারীদের ফসলের মাঠে যাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ শুধু তাই নয়, পরে রাতে ঐ সিদ্ধান্ত মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে জানিয়েও দেয়া হয়৷

কল্যাণপুর গ্রামের জাহেদা খাতুন ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘‘বাড়ির কাছে মাঠ হওয়ায় আমরা গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটতাম৷ নিষেধ করায় আমাদের ঘাস কাটা বন্ধ হয়ে গেছে৷ ফলে গবাদি পশুকে খাবার দিতে পারছি না আমরা৷ এছাড়া যে সব নারী জীবীকার জন্য বাইরে কাজ করেন, তাঁরাও বাইরে যেতে পারছেন না৷ ফসলের মাঠ বলা হলেও আসলে নারীদের বাইরে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷''

‘মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জেম এবং মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি – এই চারজনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে’

ওদিকে ফতোয়া দেয়ার পর কল্যাণপুর জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাওলানা মো. আলতাফ হোসেন সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ‘‘এটা গ্রামের মানুষের সিদ্ধান্ত৷ তাঁদের কথায়, নারীরা মাঠে গেলে ফসলের ক্ষতি হয়৷ সেজন্য মাঠে পাহারাদার রাখার সিদ্ধান্ত হয় এবং এই সিদ্ধান্তটি মাইকে ঘোষণা করা হয়৷''

মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় স্কুল শিক্ষক মতিউর রহমান দাবি করেন, ‘‘গ্রামের বেশির ভাগ লোকের দাবি, নারীরা মাঠে যাওয়ায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে৷ তাই তাঁদের মাঠে যেতে নিষেধ করে, মাঠে চৌকিদার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে৷''

সংবাদমাধ্যমে এই ফতোয়ার কথা প্রকাশ পেলে মসজিদের ইমাম আবু মুছাকে মঙ্গলবার আটক করে পুলিশ৷ এছাড়া আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়া হয় বলে জানান স্থানীয়রা৷ এরপর অবশ্য মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আর কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি৷ তাঁদের মোবাইল ফোনও বন্ধ৷ কুমারখালী মহিলা পরিষদের সভানেত্রী রওশন আরা মিলা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা ঘটনা শোনার পরই প্রতিবাদ জানিয়েছি, এলাকায় গেছি৷ সেখানে নারীদের ঘরে বন্দি রাখার জন্যই এই ফতোয়া দেয়া হয়েছে৷ এর পেছনে একটি কুচক্রী মহলের ইন্ধন আছে৷ তারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকাটি ধর্মের নামে নানা কুপমণ্ডুকতায় বেঁধে রেখে নিজেদের আধিপত্য কায়েম রেখেছে৷''

‘‘একটি মহল চায় নারীদের ঘরে বন্দি রাখতে, নানা উপায় খোঁজে ফতোয়া তাদের জন্য একটি হাতিয়ার’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘ঐ এলকার অনেক নারী পশুপালনের সঙ্গে জড়িত৷ নিজেরাও তাঁরা ঘরের বাইরে নানা কাজ করেন জীবিকা নির্বাহের জন্য৷ এমনকি ফসলের মাঠেও কাজ করেন৷ এই ফতোয়ার ফলে তাঁরা ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না৷''

রসুল করিম নামে ঐ এলকার একজন জানান, ‘‘পুলিশ মসজিদের ইমামসহ চারজনকে আটক করলেও ফতোয়া এখনও প্রত্যাহার হয়নি৷ তাই নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না৷ যাঁরা ফতোয়ার নেপথ্যে তারা আটকদের ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে তদবির করছেন৷''

রওশন আরা বলেন, ‘‘ফতোয়াবাজরা বলছেন নারীরা গবাদী পশুর খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে কলার বাগান থেকে কলা ও অন্যান্য ফল চুরি করে নিয়ে যায়৷ এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না৷ চোরের আবার নারী-পুরুষ আছে নাকি? আসলে এলকার একটি প্রভাশালী মহল নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করতে দিতে চায় না৷''কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জেম এবং মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি – এই চারজনকে আটক করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ আর সেই মসজিদের মাইক থেকেই আবারো ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়েছে যে নারীদের ফসলের মাঠ বা বাইরে কাজে যেতে কোনো বাধ নাই৷''

‘‘পুলিশ মসজিদের ইমামসহ চারজনকে আটক করলেও ফতোয়া এখনও প্রত্যাহার হয়নি’’

বাংলাদেশে ফতোয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট রায় আছে৷ তাতে কোন বিষয়ে ফতোয়া দেয়া যাবে, কারা দিতে পারবেন, ধরণ কী হবে – তাও বলে দেয়া হয়েছে৷ তারপরও বাংলাদেশে নিবর্তণমূলক ফতোয়া কমছে না৷ বলা বাহুল্য, এ সব ফতোয়ার প্রধান শিকার হচ্ছেন নারীরা৷

২০১১ সালের ১ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ফতোয়া নিয়ে এক চূড়ান্ত রায়ে বলা হয়, ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেয়া যেতে পারে, তবে স্বীকৃত ধর্মীয় বিদ্যায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই কেবল ফতোয়া দিতে পারবেন৷ এছাড়া ফতোয়া কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ বা প্রভাব বিস্তার করা যাবে না৷ ফতোয়ার নামে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি হয় এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না৷

রায়ে আরও বলা হয়, দেশের প্রচলিত আইনে বিধান আছে, এমন বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে কারুর অধিকার, খ্যাতি বা সম্মানহানি করা যাবে না৷

২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এই রায় প্রদানকরী বেঞ্চের ছ'জন বিচারপতি ছিলেন – বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী৷

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায়ে লিখেছেন, একজন মুফতি, মাওলানা অথবা ইমাম ফতোয়া ঘোষণা করতে পারেন যদি তাঁকে অনুরোধ করা হয়৷ কিন্তু তিনি দেশের কোনো আইন ভঙ্গ করতে পারেন না৷ একইসঙ্গে তাঁকে অন্যদের ফতোয়া বা মতামতের ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে৷''

‘‘ ঘটনা শোনার পরই প্রতিবাদ জানিয়েছি, এলাকায় গেছি, এর পেছনে একটি কুচক্রী মহলের ইন্ধন আছে’’

এর আগে ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট৷ সে সময় বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই রায় দেয়৷ রায়ে ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে হাইকোর্ট৷ এই রায়ের বিরুদ্ধে মুফতি মো. তৈয়ব ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ঐ বছরই আপীল দায়ের করেন৷

নারী নেত্রী এবং জাতীয় মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ফেলেকে বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের ঐ রায়ের আলোকে ফতোয়া নিয়ে তাদের নির্দেশনাগুলো ব্যবপকভাবে প্রচার করতে হবে৷ মানুষকে সচেতন করতে হবে৷ আর এগুলো বেশি প্রচার করতে হবে মসজিদ মাদ্রাসায়৷ মাদ্রাসার ইমামদের এটা প্রচারের দায়িত্ব দিতে হবে৷ মানুষকে সচেতন না করলে ফতোয়া বন্ধ করা যাবে না৷''

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘একটি মহল চায় নারীদের ঘরে বন্দি রাখতে৷ তারা এ জন্য নানা উপায় খোঁজে৷ ফতোয়া তাদের জন্য একটি হাতিয়ার৷ তবে ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কঠোর হলে এই প্রবণতা কমবে৷''

এ বিষয়ে আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য