জার্মানিতে সৌরচুল্লি
৭ আগস্ট ২০১২কোলোন-বন বিমানবন্দরে পাওয়া যাবে জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্রের প্রাঙ্গণ৷ তার ঠিক মাঝখানে একটি আট মিটার উঁচু ও সাত মিটার চওড়া আয়না, অর্থাৎ আয়নার কাচ বসানো দেওয়াল৷ এটিকে পরিভাষায় বলে হেলিওস্ট্যাট৷ হেলিওস্ট্যাটটিকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে এমনভাবে নড়ানো-চড়ানো যায়, যাতে তার আয়নাগুলি থেকে প্রতিফলিত সূর্যালোক সবসময়েই একটি তথাকথিত কন্সেনট্রেটর'এর উপরে গিয়ে পড়বে৷
নাম কন্সেনট্রেটর কেননা এর কাজ হল প্রতিফলিত সূর্যালোককে অধিশ্রয়ণবদ্ধ অর্থাৎ ফোকাস করা৷ কন্সেনট্রেটরটি আসলে একটি অধিবৃত্ত বা প্যারাবোলা আকৃতির আয়না বা আয়নার সমষ্টি: তাতে ১৫৯টি ষড়ভুজ আয়না মৌমাছির চাকের পদ্ধতিতে লাগানো আছে৷ এই কন্সেনট্রেটর'এর আয়তন এবং বাইরে হেলিওস্ট্যাট'এর আয়তন এক৷ কন্সেনট্রেটর'এর আয়নাগুলিকে প্রতিবার নতুন করে বিন্যাস করার কোনো প্রয়োজন নেই, সেগুলি আগে থেকেই এমনভাবে অ্যাডজাস্ট করা আছে যে, তারা একটি অধিশ্রয়ণবিন্দুর দিকে সূর্যালোক নিক্ষেপ করছে৷ এই ফোকাল পয়েন্টে একত্রিত, সমষ্টিবদ্ধ সূর্যরশ্মির তীব্রতা সাধারণের চেয়ে ৫,০০০ গুণ বেশি৷
ল্যাবরেটরির ভিতরে একটি এক্সপেরিমেন্টের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্রিস্টিয়ান রেডার৷ একটি বায়ুশূন্য বাক্স, তার একদিকে কাচ লাগানো৷ মহাশূন্যযাত্রা সংত্রান্ত একটি কোম্পানি তাদের একটি পণ্য এই বাক্সে পরীক্ষা করতে চায়৷ পণ্যটি পরে একটি কৃত্রিম উপগ্রহে লাগানো হবে৷ কাজেই মহাশূন্যে বায়ুশূন্য অবস্থায় সেটি কি পরিমাণ সূর্যালোক ও তাপ সহ্য করতে পারে, সেটাই পরীক্ষা করে দেখা হবে৷ কিন্তু যেহেতু এই সোলার ওভেন বা সূর্যচুল্লিটি অতি তাড়াতাড়ি অতীব গরম হয়ে ওঠে, তাই মাত্র স্বল্পসময়ের জন্য পরীক্ষা চালানো হবে৷ এবং সেটা যখন আকাশ পুরোপুরি মেঘশূন্য৷ এ ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমস্যাটা সেখানেই, বললেন ক্রিস্টিয়ান রেডার:
‘‘কখনো-সখনো আমরা সারা সকালটা ধরে দেখি, মেঘ হচ্ছে কি হচ্ছে না৷ কি ধরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার ওপরেও সেটা নির্ভর করবে৷ গতবার আমাদের বলা ছিল, ৭০ সেকেন্ড সোলার ওভেনে রাখবে৷ এর পরের এক্সপেরিমেন্টে দশ সেকেন্ডের বেশি রাখলে চলবে না৷ আবার এমন এক্সপেরিমেন্টও আছে, যেখানে সারাদিন ধরে বস্তুটিকে ওভেনে রাখতে হবে৷''
জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্র বা ডিএলআর'এর পদার্থবিদরা এভাবে মোটরগাড়ির বার্নিশ ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখেন৷ যেমন এক বছর ধরে সূর্যালোকে গাড়ি চললে বিশেষ করে অতিবেগুনি রশ্মির দরুণ গাড়ির রঙ বা বার্নিশের কি ক্ষতি হয়, সেটা জানার জন্য এক বছর ধরে পরীক্ষা চালানোর দরকার নেই৷ ডিএলআর'এর সোলার ওভেনে সেটা একদিনের মধ্যেই জানা যেতে পারে৷ এ কাজে সোলার ওভেনে ৩০০ থেকে ৫০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপন্ন করা হয়৷ তবে ডিএলআর'এর সোলার ওভেন তার চাইতে অনেক বেশি তাপমাত্রা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে, জানালেন সৌরশক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ গের্ড ডিবোভস্কি:
‘‘আমরা ২,৫০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পারি৷ মহাকাশযানগুলি পৃথিবীর বাযুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় যে তাপ সৃষ্টি হয়, তা থেকে সুরক্ষার জন্য সেরামিক বা চীনেমাটির টালি ব্যবহার করা হয়৷ সেগুলো এখানে খুবই সহজে টেস্ট করা যায়৷''
সোলার ওভেনে ৮০০ থেকে ১,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে সেই বাষ্প থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করা যায়৷ আবর্জনা পোড়ানো থেকে শুরু করে অ্যালুমিনিয়াম গলিয়ে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করা, এ সব কাজেই ডিএলআর'এর সূর্যচুল্লি কাজে লাগানো যেতে পারে৷ এবং এই সূর্যচুল্লি পদ্ধতিতে তাপ সৃষ্টি করে বাষ্পচালিত টারবাইন থেকে শিল্পপর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে, স্পেনের আলমেরিয়ায় ইতিমধ্যেই যা করা হচ্ছে৷
খেয়াল করতে হবে, সৌরশক্তি দিয়ে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে, ডিএলআর'এর বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন, কেননা তা অনেক বেশি কার্যকরি, যেমন হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে৷ অপরদিকে টারবাইন চালানোর জন্যও সৌরশক্তির ব্যবহার অনেক বেশি কার্যকরি প্রমাণিত হয়েছে৷
প্রতিবেদন: ফাবিয়ান স্মিট / এসি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ